মধ্যযুগের অন্ধকার থেকে আলোকায়ন যুগের ফরাসী দার্শনিক ভলতেয়ারকে আমরা ঠিক ওই অর্থে চিনি না, সময়ের বিরুদ্ধ-স্রোতে তার লড়াই-সংগ্রামের নোটবুক, চিন্তা ও দর্শনের সঙ্গে যতোটা পরিচয় ঘটলে- চেনা বলা যায়। কিন্তু মতপ্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষায় তার জগদ্বিখ্যাত উক্তিটি পাঠকমাত্রই জানেন। তিনি বলেছিলেন, ‘আমি তোমার কথার সঙ্গে একমত না হতে পারি, কিন্তু তোমার কথা বলার অধিকার রক্ষার জন্য আমি জীবন দেবো।’
এইটুকুর সঙ্গে সহমত পোষণ করলেও তসলিমা নাসরিনকে নির্বাসনে জীবন কাটাতে হতো না। একজন লেখকের কথা বলার অধিকার, মতপ্রকাশের অধিকার, লেখার অধিকার একটি সভ্য সমাজের মানদণ্ড। যদি তা নিশ্চিত করা না যায়, বুঝতে হবে আমরা সভ্য হতে পারিনি। আমাদের সমাজ, সভ্যতা এখনো আদিম ও অন্ধকারাচ্ছন্ন। কারও চিন্তা ও লেখার সঙ্গে একমত না হলেই তার মাথার মূল্য ঘোষণা করতে হবে? আক্রমণ করতে হবে? নির্বাসন দিতে হবে?
এগুলো একটি বর্বর অসভ্য অবিকশিত সমাজের লক্ষণ। আমাদের চিন্তা-চেতনা কী সেই আদিম অসহিষ্ণু সমাজ থেকে উত্তরণ ঘটছে? যে লেখক কারও চিন্তাধারায় প্রবল ধাক্কা দিতে পারেন না, তিনি আদৌ কোনো লেখকই নন। তসলিমা নাসরিন তার লেখায় সে প্রবল ধাক্কাটাই দিয়েছিলেন। অচলায়তন ভেঙেছিলেন। শান্ত জলদিতে বিপুল তরঙ্গ তুলেছিলেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা গেছে, একজন লেখকের লেখা ভালো করে না পড়েই তার বিরুদ্ধে কিছু মানুষের উসকানি ও বিদ্বেষমূলক কথায় একটি শ্রেণিকে সহজেই লেলিয়ে দেওয়া যায়। অধ্যাপক জাফর ইকবালের বিরুদ্ধে এমন একটি বিক্ষোভের সময় বিষোদগারকারীকে সাংবাদিক প্রশ্ন করলে বিক্ষোভকারী এ সম্পর্কে বিস্তারিত কিছুই না জেনেও বিক্ষোভে অংশ নিয়েছেন বলে জানান। চিলে কান নিয়েছে গল্পের মতো অবস্থা আরকি। তসলিমার ক্ষেত্রেও তার ব্যত্যয় ঘটেনি। কিছু ধর্মান্ধ উগ্রবাদী লোক সবসময় মসির জবাব অসি দিয়েই দিতে চেয়েছে।
অন্ধকার ঘুচে যাক তসলিমা নাসরিন
আত্মজীবনীমূলক লেখা এবং প্রবন্ধ, কলাম ছাড়াও তসলিমা নাসরিন সবসময়ই একজন কবি হিসেবে শক্তিমান। বলা হয়, লেখক ও শিল্পীর মতো দেশকে কেউ ভালোবাসে না। কারণ ভালোবাসাকে তারা শিল্পরূপ দেন এবং অন্যের মধ্যেও তা ছড়িয়ে দেন। বাংলা ভাষার প্রতি তাচ্ছিল্য প্রকাশ করা, ইংরেজ সমাজ ও ভাষায় প্রতিষ্ঠিত হতে চাওয়া মাইকেল মধুসূদনও বিদেশ বিভূঁইয়ে ঘুরে লিখেছিলেন কপোতাক্ষ নদ ও বাংলা ভাষার প্রতি প্রগাঢ় ভালোবাসারই কথা। আমাদের ভাগ্য, ঔপনিবেশিক আমলে ইংরেজিতে চমৎকার দখল থাকার পরও রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন বাংলা ভাষাতেই এবং সমৃদ্ধ করে গেছেন এ ভাষা। তিরিশের সবচেয়ে শক্তিমান কবি জীবনানন্দ দাশের কবিতা চিরকাল এই বাংলার কথাই বলবে। যত দূরে নির্বাসনে যান তসলিমা নাসরিনও এই বাংলা ভাষাতেই লিখতে চেয়েছেন আমৃত্যু।
তসলিমা নাসরিনের জন্ম ১৯৬২ সালের ২৫ আগস্ট ময়মনসিংহ শহরে। তার প্রকৃত নাম নাসরিন জাহান তসলিমা। জানা যায়, স্কুল জীবনে সাহিত্যচর্চার সময়ই তিনি ‘তসলিমা নাসরিন’ নামে আত্মপ্রকাশ করেন। ২ ভাই ২ বোনের মধ্যে তিনি তৃতীয়। শৈশব ও যৌবনের বিশদ বিবরণ তার আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ ‘আমার মেয়েবেলা’ ও উতল হাওয়া’য় পাওয়া যায়। তার পিতা রজব আলী পেশায় চিকিৎসক ছিলেন। শুধু এই পরিচয়টুকুই যথেষ্ট নয়। তিনি আধুনিক ও সংস্কারমুক্ত একজন মানুষ ছিলেন। পিতার মুক্তমন ও জীবন তাকে বিপুলভাবে প্রভাবিত করেছিল। মা ইদুল আরা সাধারণ গৃহিণী ছিলেন।
তসলিমা ১৯৭৬ সালে ময়মনসিংহ থেকে এসএসসি পাস করেন। ১৯৭৮ সালে তিনি আনন্দ মোহন কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে ভর্তি হন এবং সেখান থেকে ১৯৮৬ সালে এমবিবিএস পাস করেন। একই বছর ‘শিকড়ে বিপুল ক্ষুধা’ শিরোনামে তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ পায়। সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসক হিসেবে চাকরি জীবন শুরু করেন। ধর্মান্ধদের খুনের ফতোয়া, হামলা ও মামলা ও সরকারের দায়ের করা জামিন-অযোগ্য গ্রেপ্তারি পরোয়ানার মুখে তিনি যখন ১৯৯৪ সালে দেশত্যাগ করেন, তখন সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কর্মরত ছিলেন। সেসময় তসলিমা শুধু দেশে নয়, গোটা বিশ্ব মিডিয়ায় শিরোনামে থাকা আলোচিত এক নাম।
ময়মনসিংহের ব্রহ্মপুত্র নদের পাড়ের আগুন-সাহসী সেই মেয়েটির আজ জন্মদিন। এ দেশে থেকে পালিয়ে যাওয়া যুদ্ধাপরাধী, বঙ্গবন্ধুর খুনি, ঘাতক-দালাল, দেশদ্রোহীদেরও ফিরিয়ে আনা হয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাদের রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে পুনর্বাসন করেছে রাষ্ট্র। তসলিমা নাসরিনের লেখালেখি নিয়ে বিতর্ক আছে। কেউ তার ধর্মবিশ্বাস ও লেখালেখির সঙ্গে একমত নাও হতে পারে। কিন্তু আর যাই হোক, তিনি দেশদ্রোহী, যুদ্ধাপরাধী বা খুনি নন। একজন লেখক তার মা, মাটি ও ভাষাকে গভীরভাবে ভালোবেসেই লেখালেখি করেন। কিন্তু তিনি তার মাতৃভূমিতে বসবাসের অধিকার থেকে বঞ্চিত হবেন কেন? কেন নির্বাসিত থাকবেন দীর্ঘদিন? সভ্যতার এত উন্নতির কালে রাষ্ট্রই তার জবাব দিক। তার লেখা ‘পাখি হয়েও ফিরব একদিন’– কবিতাটি দিয়েই জন্মদিনে লেখাটির ইতি টানি।
‘আমার জন্য অপেক্ষা করো মধুপুর নেত্রকোণা
অপেক্ষা করো জয়দেবপুরের চৌরাস্তা
আমি ফিরব। ফিরব ভিড়ে হট্টগোল, খরায় বন্যায়
অপেক্ষা করো চৌচালা ঘর, উঠোন, লেবুতলা, গোল্লাছুটের মাঠ
আমি ফিরব। পূর্ণিমায় গান গাইতে, দোলনায় দুলতে, ছিপ ফেলতে বাঁশবনের পুকুরে-
অপেক্ষা করো আফজাল হোসেন, খায়রুননেসা, অপেক্ষা করো ঈদুল আরা,
আমি ফিরব। ফিরব ভালবাসতে, হাসতে, জীবনের সুতোয় আবার স্বপ্ন গাঁথতে-
অপেক্ষা করো মতিঝিল, শান্তিনগর, অপেক্ষা করো ফেব্রুয়ারি বইমেলা আমি ফিরব।
মেঘ উড়ে যাচ্ছে পশ্চিম থেকে পুবে, তাকে কফোটা জল দিয়ে দিচ্ছি চোখের,
যেন গোলপুকুর পাড়ের বাড়ির টিনের চালে বৃষ্টি হয়ে ঝরে।
শীতের পাখিরা যাচ্ছে পশ্চিম থেকে পুবে, ওরা একটি করে পালক ফেলে আসবে
শাপলা পুকুরে, শীতলক্ষ্যায়, বঙ্গোপসাগরে।
ব্রহ্মপুত্র শোনো, আমি ফিরব।
শোনো শালবন বিহার, মহাস্থানগড়, সীতাকুণ্ড পাহাড়-আমি ফিরব।
যদি মানুষ হয়ে না পারি, পাখি হয়েও ফিরব একদিন।’
আলমগীর শাহরিয়ার: কবি ও গবেষক