(এক একাদশ বর্ষীয় বালকের দৃষ্টি ও অনুভূতিতে ৭৫ বছর পূর্বের দিনটির
স্মৃতিচারণ)
স্মৃতিচারণ)
১৯৪৫ সাল, মে মাস। ইউরোপে দ্বিতীয় বিশ্বমহাযুদ্ধের সমাপ্তি ঘোষণা হল। সেই রাত্রিতেই আমরা জামশেদপুর বা টাটানগর থেকে ট্রেণে কলকাতা রওয়ানা হয়েছি, বাবা দীর্ঘ দু বছর পর ঐ শহরের সামরিক হাসপাতাল থেকে বদলি হয়ে কলকাতার আলিপুরের কমান্ড মিলিটারী হাসপাতালে নিযুক্ত হয়েছেন। ট্রেনে দু-তিনটি কামরা ভর্তি আমেরিকান ও বৃটিশ সৈন্যরা, পথে প্রত্যেক স্টেশনে নেমে মদমত্ত হয়ে তাদের মহোল্লাসে বাঁধনহীন নৃত্য-গীত-হুল্লোড় অন্য যাত্রীদের বিনোদনের পরিবর্তে আশঙ্কাই সৃষ্টি করছিলো। ভোরবেলা কলকাতা পৌঁছোনো গেল। তখন স্বাধীনতা আন্দোলনের জন্য মিটিং-মিছিল-সত্যাগ্রহ-হরতাল এক নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা, সেদিনও শহরে ধর্মঘট পালিত হচ্ছে, তবে অতি প্রত্যুষে আমরা কোনোক্রমে একটি ঘোড়ার গাড়ী অবলম্বন করে ভবানীপুরে দাদামহাশয়ের বাড়ী পথে বিনা বাধায় উপনীত হলাম।
স্বাধীনতা তখন দুয়ারদ্বারে। মহাযুদ্ধের অবসানে বৃটিশ সাম্রাজ্য হীনবল, বিধ্বস্ত, তাদের শহরগুলির অনেকাংশই ধ্বংশস্তূপে পরিণত হয়েছে। এই অবস্থায় এই বিশাল দেশে, অতি প্রতিকূল পরিবেশে, ৩৪ কোটি গভীর বিদ্বেষপূর্ণ, প্রতিরোধী জনসাধারণকে নিয়ন্ত্রণ করে সুস্থ প্রশাসন চালনা করা তাদের পক্ষে কার্যতঃ অসম্ভব। ১৯৪৬ সালের ভারতীয় নৌসেনা বিদ্রোহে তাদের এই সিদ্ধান্তে শিলমোহর পড়লো। স্থির হলো যথাশীঘ্র সম্ভব তারা ভারতীয় নেতৃত্বের হাতে শাসনভার সমর্পণ করে এই দেশ পরিত্যাগ করবে।
১৬ই অগষ্ট, ১৯৪৬। কলকাতার ইতিহাসে কলঙ্কতম দিন রচিত হলো বিনা সতর্কীকরণে বীভ স সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-হাঙ্গামায়। জিন্নার প্ররোচনায়, তখন বাংলায় শাষণরত পাকিস্থানপন্থী মুসলীম লীগের ষড়যন্ত্রে, অবিভক্ত বঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী সুরাবর্দীর ইচ্ছাকৃত নিস্ক্রিয়তায় যে নারকীয় মারণযজ্ঞের অবতারণা হলো তা বিশ্বের ইতিহাসে বিরলতম। বিনা প্রতিরোধে সশস্ত্র গুন্ডাবাহিনী যথেচ্ছা খুন-জখম, অত্যাচার, লুটপাট, অগ্নিসংযোগে প্রবৃত্ত হলো। সে ভয়াবহ সময়ের কথা সেই বাল্যমনের চিত্রপটে গভীরভাবে অঙ্কিত আছে, তা কোনোদিন বিস্মরণ হবে না। পাড়ায় পাড়ায় সুরক্ষার জন্য প্রস্তুতি পড়ে গেল, ছেলেদের দল দিবারাত্রে সজাগ পাহারায় টহল দিতে লাগল, তাদের অস্ত্র ছুরি, বঁটি, লাঠিসোটা, সোডার বোতল, মশাল। আমাদের বাড়ীর ছাতে ইট-পাটকেল স্তূপাকার করে রাখা হলো, দাদামশায়ের দুনলা বন্দুকটি তেল মার্জনা করে পরিস্কৃত করে রাখা হলো শত্রুবাহিনীর মুকাবিলা করার জন্য। দুর থেকে ভেসে আসা হৈ-হট্টগোল, গোলমালের শব্দ, কোন কোন গৃহে অগ্নিসংযোগের দরুন লেলিহান অগ্নিশিখা শরীর-মনে শিহরণ, ভীতি সঞ্চার করলো। দিনের বেলা চতুর্দিক থেকে হাড়-হিমকরা দুঃসংবাদ আসে, আর আমাদের আহার-নিদ্রা ব্যাহত হয়। এই নৈরাজ্যের হিংস্র, আতঙ্ককর সময় প্রলম্বিত হয়েছিল স্বাধীনতালাভের দিন পর্যন্ত, বহু প্রাণহানি, অত্যাচার, অগ্নিসংযোগ, অবাধে লুটপাটের পর। দেশভাগ হওয়ার পর পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এলো।
১৪ই অগষ্ট, ১৯৪৭। দুরু দুরু বক্ষে, অসীম আগ্রহে আমরা অপেক্ষা করছি সেই বহু বাঞ্ছিত, ৩৪ কোটি দেশবাসীর প্রাণমনে আকাঙ্খিত আগামী কাল সেই দিনটির জন্য। দীর্ঘকালব্যাপী কোটি কোটি জনসাধারণের প্রাণান্তকর সংগ্রামের ফসল বিদেশী শাষনমুক্ত সম্পূর্ণ স্বনিয়ন্ত্রিত স্বাধীন দেশ, এ যেন আমাদের এক স্বর্গীয়, মধুর স্বপ্নের রূপায়ণ! এই দিনটি ক্ষুদিরাম-প্রফুল্লচাকী সমেত বহু শহীদের পুণ্য রক্ত-তর্পণে শুদ্ধ, সুদীর্ঘ কালের সংগ্রামের, অসংখ্য নেতা ও কত সাধারণ মানুষের জীবননাশ, ত্যাগ, অত্যাচার, কারাবাস ও অমিত দুঃখবরণের সার্থক পরিণাম। আর তো কয়েক ঘন্টার অপেক্ষা!
সে রাত্রে সবার চোখে নিদ্রা সূদুর পরাহত। প্রতিটি মিনিট, প্রতি পল-অনুপল আমরা গুণছি সেই মহামূহুর্তের জন্য, যখন ভারতবর্ষ পৃথিবীর মানচিত্রে একটি অনন্য বিশাল স্বাধীন উপমহাদেশ হিসাবে স্বীকৃত হবে, যখন আমরা গর্বভরে, মস্তক উন্নত করে জগতের অন্যান্য স্বাধীন দেশগুলির সাথে একাসনে বসার অধিকারের সম্মান অর্জন করব।
ঠিক মধ্যরাত্রির ঘন্টা বাজলো। সঙ্গে সঙ্গে ঘরে ঘরে শঙ্খধ্বনি, উলুধ্বনির নিনাদ, মন্দিরে মন্দিরে কাঁসর-ঘন্টা-ঢাক বাদ্য সহযোগে দেব-দেবীর বিশেষ পূজা ও আরতি, গীর্জাগুলিতে ঘন্টাধ্বনি, বন্দরে একাধিক জাহাজের সুতীক্ষ্ণ বাঁশী, ফোর্ট উইলিয়াম থেকে কামান দাগা হল। দিল্লী থেকে বেতারে ভেসে আসছে নেহরুজির লোকসভায় সদস্যদের সন্মুখে সেই গায়ে কাঁটা দেওয়া ভাষণ, Tryst with Destiny। বড়রা নিবিড় মনঃসংযোগে শুনছেন সেই অসাধারণ ভাষণ, আমরা ছোটরা পাশে বসে বুঝবার চেষ্টায় আছি, কি এক আবেগে কণ্ঠ অবরুদ্ধ, চক্ষু বাষ্পাচ্ছন্ন, এক অপূর্ব সম্মোহনের পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। তারপর তিনি স্বাধীন ভারতের প্রথম পতাকা উত্তোলন করলেন দিল্লীর ইন্ডিয়া গেটে, বেতারে সেই শ্রবণেই আমরা স্বতঃস্ফূর্ত, তাৎক্ষণিক স্বোচ্ছাসে নৃত্য, গীত ও করতালি দিয়ে সদ্যোজাত নবভারতকে প্রণতি জানালাম।
সেই মধ্য রাত্রিতেই গৃহবাসীরা উল্লাসে মাতোয়ারা হয়ে রাস্তায়,পথে,পার্ক-উদ্যানে বহির্গত। সম্পূর্ণ অপরিচিতরাও পরষ্পরের প্রতি প্রীতি-সম্ভাষণ, কোলাকুলি, দেশবাসীরা যেন এক অখন্ড ভ্রাতৃবন্ধনে আবদ্ধ, তাদের যেন একটিই পরিচয়, তারা স্বাধীন ভারতবাসী। ঠিক এক বছর পূর্বে যে কদর্য ভ্রাতৃঘাতী নিধনযজ্ঞে চার সহস্রাধিক প্রাণ বলিদান হয়েছিল সেটি আজ যেন এক অলীক দুঃস্বপ্ন, আজ কোলাকুলির, প্রীতির মেলবন্ধনে ধর্ম, জাতি, প্রাদেশিকতা সব একাকার…..এক জাতি, এক প্রাণ, একতা। আবির খেলায় আকাশ-বাতাস রঙ্গীন, এই অকাল হোলি উৎসবে সর্বজন মাতোয়ারা! কালী পটকা, দোদমার কর্ণবিদারী আওয়াজে, তুবড়ীর অগ্নি ফোয়ারায় অকাল দীপাবলীর আমেজ এসে যায়। সব মিষ্টান্ন ভান্ডার খোলা, অকাতরে রসগোল্লা-সন্দেশের হরির লুট চলছে, দোকানীরা আজ দরাজ দিল! এক অত্যুৎসাহী মাস্তুতো দাদা বৌবাজারের ভীমনাগের দোকান থেকে তাদের নব সৃষ্টি তেরঙ্গা সন্দেশ এনে হাজির, আমাদের উৎসাহের অন্ত নেই! বোরোলীন, জবাকুসুম, লিলি বিস্কুট ঘোষণা করেছে স্বাধীনতা দিবসে প্রতিটি প্রতিষ্ঠান এক হাজার পণ্যদ্রব্য বিনামূল্যে বিতরণ করবে।
ভোরের আলো ফুটে উঠল। নবজাতক শিশু স্বাধীন ভারতবর্ষে আজ প্রথম সূর্যোদয়। অগণিত প্রভাত-ফেরীর গান শোনা যাচ্ছে….ও আমার দেশের মাটি তোমার পায়ে ঠেকাই মাথা। তখন প্রতিটি বিশিষ্ট দিনের ভোরে প্রভাত-ফেরীর সুরে আমাদের ঘুম ভাঙ্গতো, নেতাজীর জন্মদিন, ২৫শে বৈশাখ, দোলযাত্রা, নববর্ষে। পাড়ায় পাড়ায় ছেলেমেয়েরা ভাড়া লরীতে শহর পরিক্রমা করতো, গানে, আবৃত্তিতে মাতিয়ে দিয়ে। আজ সবই দেশাত্মবোধক গান সমবেতকণ্ঠে শোনা যায়, একটি দল উচ্চতানে পরিবেশন করছে
বল বল বল সবে শত বীণা-বেনু-রবে
ভারত আবার জগৎসভায় শ্রেষ্ঠ আসন লবে
আমাদের পাড়ার ছেলেমেয়েরা বোধহয় লরী যোগাড়ে অক্ষম হয়েছে, অদম্য উৎসাহে তারা পদযাত্রার সাথে সাথেই উদাত্তকণ্ঠে গাইছে
সকল দেশের রাণী সে যে আমার জন্মভুমি
তাদের অত্যুৎসাহী একজনের গলায় দোদ্যুলমান একটি চাদরে আবার একটি হারমোনিয়াম শোভা পাচ্ছে !
বেলা বাড়বার সাথে কয়েকটি অভিভাবকের পরিচালনায় আমরা ছোটরাও রাস্তায় বেরিয়ে পড়লাম, শহরের অধিবাসীরা কি ভাবে অবারিত আনন্দ-উৎসবের ফোয়ারায় মেতে উঠেছে, এই দৃশ্য তো জীবনে একবার বই দুবার আসে না। কিন্তু তার মধ্যেও একটি বেদনা পাষাণের ন্যায় হৃদয় ভারাক্রান্ত করে আছে, এই আনন্দ-যজ্ঞের হোতা দেশবাসীর সেই প্রিয়তম প্রাণপুরুষ কোথায় ? নেতাজী বিহনে এ যেন শিবহীন যজ্ঞ, রামবিহীন অযোধ্যা! আজ সেই পুরুষশ্রেষ্ঠের বাসভবন মহাতীর্থে পরিণত হয়েছে, আজ আপামর শহরবাসীর শ্রদ্ধানিবেদনের গন্তব্যস্থল এলগিন রোড। তাই কি বারংবার শোনা যাচ্ছে সমবেত আকুল কণ্ঠে সেই গীতটির ধ্বনি…..তোমার আসন শূণ্য আজি, হে বীর পূর্ণ করো!
আর পাখীর চোখের মত গভর্ণমেন্ট হাউস….এখন রাজ ভবন…..দর্শনের জন্য জনতা হাঁটা দিয়েছে ডালহাউসি স্ক্যোয়ারে। কোনো পরিবহনে যাওয়া অসম্ভব, যদিও আজ সবই বিনা মাশুলে। বাদুড়-ঝোলা বইতেই পড়েছি, আজ চাক্ষুষ অভিজ্ঞতা হলো কি ভাবে বাস-ট্র্যামের ভিতরে, সন্মুখে, পশ্চাতে এমন কি ছাতেও ভ্রমণ করা যায় এই অবিশ্বাস্য দৃশ্যে! ছোটলাটসাহেবের এই প্রাসাদ সিপাই-শান্ত্রীর পাহারায় সূচিভেদ্য সুরক্ষায় পরিবেষ্টিত হয়ে থাকে, তিনি কলকাতা ত্যাগ করেছেন, আজ ঘোষণা করা হয়েছে হর্ম্যটি জনসাধারণের পরিদর্শনের জন্য উন্মুক্ত। বিদেশি শাষকবর্গ দেশের সম্পত্তি দেশবাসীর হাতেই সমর্পণ করেছে। তবে এর ফলে কিছু পরিতাপজনক ঘটনা ঘটলো, কিছু বিশৃঙ্খল দর্শনার্থীদের অবাঞ্ছিত ক্রিয়াকলাপের ফলে কয়েকটি দামী আসবাব, অমূল্য ভাস্কর্য ও চিত্রকলা ক্ষতিগ্রস্ত হল।
আজ বাড়ীতে ভোজন-মহোৎসব। রাঁধুনী ব্রাহ্মণকে সরিয়ে মাসীমারা কোমর বেঁধে রাঁধতে লেগেছেন…গোবিন্দভোগ চালের পোলাও, ছোলার ডাল, তপসে মাছ ভাজা, পাকা রুই মাছের কালিয়া, আলুবখরার চাটনী ও ছানার পায়েস। এই শেষোক্ত পদটি আমার সত্তরোর্দ্ধ দিদিমার স্বহস্তে সযত্নে সৃষ্টি, এই অমৃততুল্য সুখাদ্যটির স্বাদের তুলনায় ক্ষীর-রাবড়ী-মালাইও হেয় মনে হতো। অতি সাত্বিক দাদামশায়ের গৃহে মাংস, মুরগীর ডিমের প্রবেশ নিষিদ্ধ।
সন্ধ্যা নামলো। সব বিশিষ্ট সরকারী ভবন, যাদুঘর, মনুমেন্ট, ভিক্টোরিয়া আলোকমালায় সজ্জিত, সাধারণ সব গৃহে অসংখ্য প্রদীপ, মোমবাতির বাহার…তখন তো টুনি বাল্বের প্রচলন হয় নি….চিরপরিচিত শহরটি মনে হচ্ছে সম্পূর্ণ অচেনা, যেন কোন ঋষির মন্ত্রবলে এটি একটি অপরূপ জ্যোতির্ময় মায়াপুরীতে পরিণত হয়েছে।
হৈ-হুল্লোড়, আকাশে তারাবাজি, ঢাকের বাদ্যি, গানের সুরচ্ছটার মধ্য দিয়ে এই স্বপ্নময় দিনটির অবসান হল। সন্মুখে কঠিন সংগ্রাম, শুরু হবে পরিশ্রম, শিক্ষা, শৃঙ্খলা ও সততার মাধ্যমে আমাদের এই নিপীড়িত, ক্ষতবিক্ষত দেশটিকে পুনর্গঠন করে বিশ্বসভায় উচ্চমর্য্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করা।