কম্পিউটার ডিজাইন মেনে বিশেষ এক ধরনের ব্যাঙের কোষ নতুন ধরনের প্রাণ তৈরি করেছে। অতি ক্ষুদ্র এই জীবসত্তা (অর্গানিজম) ক্ষুদ্র থালায় সাঁতার কাটতে পারে, নতুন একক কোষ খুঁজে বের করতে পারে ও এক সঙ্গে শত শত একত্রিত হতে সক্ষম।
টিকে থাকার প্রয়োজনে জীবের বংশবৃদ্ধি আবশ্যিক প্রাকৃতিক ঘটনা। তবে এই প্রথম জৈবিক প্রজননে সক্ষম রোবট উদ্ভাবন করেছেন বিজ্ঞানীরা। তারা বলছেন, এই জীবন্ত রোবট ক্রমাগত তৈরি করতে পারে নিজের প্রতিলিপি।
যুক্তরাষ্ট্রের একদল বিজ্ঞানীর তৈরি রোবট এক ধরনের জেনোবট (জীবন্ত রোবট) । তবে রোবট বলতে প্রচলিত অর্থে আমরা যা বুঝি এই জেনোবট ঠিক তেমন নয়। সুপার কম্পিউটারের ডিজাইন অনুসারে জৈবিক বংশবিস্তারের এক নতুন কৌশল কাজে লাগানো হয়েছে এ ক্ষেত্রে।
গবেষণাগারে এই ডিজাইন মেনে বিশেষ এক ধরনের ব্যাঙের কোষ নতুন ধরনের প্রাণ তৈরি করেছে। অতি ক্ষুদ্র এই জীবসত্তা (অর্গানিজম) ক্ষুদ্র থালায় সাঁতার কাটতে পারে, নতুন একক কোষ খুঁজে বের করতে পারে ও এক সঙ্গে শত শত একত্রিত হতে সক্ষম।
এক মিলিমিটারের চেয়েও ছোট (০.০৪ ইঞ্চি) জেনোবটগুলো শিশু জেনোবট তৈরি করতে পারে। এসব শিশু জেনোবট এরপর আবার নতুন কোষ খুঁজে বের করে নিজেদের প্রতিলিপি তৈরি করতে সক্ষম। বিজ্ঞানীরা বলছেন, এই জেনোবট সনাতনি ধরনের রোবট যেমন নয়, তেমনি আবার কোনো প্রচলিত প্রাণীও নয়। কম্পিউটারে তৈরি ডিজাইন অনুসারে এটি কাজ করে এবং অতিক্ষুদ্র এই জীবসত্তার মাধ্যমে আগামীতে মানবদেহের অভ্যন্তরে ওষুধ পরিবহন সম্ভব।
গবেষণা দলের সদস্য যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অফ ভারমন্টের (ইউভিএম) কম্পিউটার বিজ্ঞানী ও রোবটিকস বিশেষজ্ঞ জশুয়া বোনগার্ড বলেন, ‘সঠিক ডিজাইন করা গেলে জেনোবটগুলো নিজে থেকেই নিজেদের প্রতিলিপি তৈরি করবে।’
তাদের গবেষণার ফল গত ২৯ নভেম্বর প্রসিডিংস অফ দ্য ন্যাশনাল অ্যাকাডেমি অফ সায়েন্সে প্রকাশিত হয়েছে।
জেনোবট তৈরিতে বেছে নেয়া হয়েছে আফ্রিকান ব্যাঙের প্রজাতি জেনোপাস লিভিসের বিশেষ ধরনের কোষ। এই ভ্রূণ কোষগুলো পরে ব্যাঙের ত্বকে পরিণত হয়।
গবেষণা দলের আরেক সদস্য ম্যাসাচুসেটসের টাফটস ইউনিভার্সিটির জীববিজ্ঞানের অধ্যাপক মাইকেল লেভিন বলেন, ‘বিশেষ ভ্রূণকোষগুলো ব্যাঙাচি জন্মের ত্বক আবরণ তৈরি করে। এই কোষ শ্লেষাজাতীয় পদার্থের নিঃসরণ ঘটিয়ে ব্যাঙকে রোগজীবাণুর হাত থেকে সুরক্ষিত রাখে। তবে ল্যাবরেটরিতে আমরা এদের নতুন একটি পরিস্থিতিতে রেখেছি। এগুলোর বহুকোষী বৈশিষ্ট্যকে নতুন ভাবে কাজে লাগানোর সুযোগ তৈরি করেছি। এর ফলে কোষগুলো নতুন যা তৈরি করছে তা ত্বক থেকে একেবারে আলাদা।’
গবেষক দলের সদস্য টাফটস ইউনিভার্সিটির বিজ্ঞানী ডগলাস ব্ল্যাকিস্টন বলেন, ‘এতদিন মানুষের ধারণা ছিল, জীবনের বিস্তার বা বংশবৃদ্ধি কীভাবে ঘটে সে বিষয়ক সব রহস্য ভেদ করে ফেলা হয়েছে। কিন্তু আমাদের এই পরীক্ষা এমন কিছু পাওয়া গেছে যা আগে কখনও দেখা যায়নি।’
বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছে গবেষক দলটি। অধ্যাপক মাইকেল লেভিন বলেন, ‘এই কোষগুলোতে ব্যাঙের জিনোম রয়েছে, কিন্তু এরা ব্যাঙাচিতে পরিণতা হওয়ার দায়িত্ব থেকে মুক্ত। ফলে এরা যৌথ বুদ্ধিমত্তা, নমনীয়তা প্রয়োগ করে অবাক করার মতো অনেক কিছু ঘটাতে সক্ষম।’
গবেষণায় দেখা গেছে, কম্পিউটারে ডিজাইন করা কোষগুলো নিজে থেকেই নিজের প্রতিলিপি তৈরি করতে পারে।
গবেষণা দলের প্রধান স্যাম ক্রিগম্যান বলেন, ‘ব্যাঙের এই কোষগুলো নিজেদের প্রতিলিপি তৈরি করছে এক দম আলাদা পদ্ধতিতে। ব্যাঙের দেহে সাধারণভাবে প্রতিলিপি তৈরির চেয়ে এই প্রক্রিয়া একেবারে ভিন্ন।’
জেনোবটের জনক কোষ নিজে থেকেই ৩ হাজার কোষের সমন্বয় ঘটিয়ে একটি বৃত্ত তৈরি করে।
ক্রিগম্যান বলেন, ‘এগুলো সন্তান তৈরি করতে পারে, কিন্তু এর পরই প্রক্রিয়াটির অবসান ঘটে। এই প্রক্রিয়াটি অব্যাহত রাখার পদ্ধতিটি খুবই জটিল।’
জেনোবটের আকৃতি তৈরির জন্য গবেষণায় ডিপ গ্রিন সুপার কম্পিউটারে আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই) প্রোগ্রামের নতুন ধরনের এলগরিদম ব্যবহার করা হয়েছে। কোন আকৃতি বংশবিস্তারের জন্য উপযোগী সেটি জানতে ত্রিভূজ, চতুষ্কোণ, পিরামিড বা তারকাকৃতি তৈরি করা হয়েছে।
ক্রিগম্যান বলেন, ‘আমরা কম্পিউটারকে বলেছিলাম, জনকের আকৃতি ঠিক করতে। এআই কয়েক মাস চেষ্টার পর কয়েকটি অদ্ভূত ধরনের আকৃতি তৈরি করে, যার একটি দেখতে প্যাক-ম্যানের (ভিডিও গেইম চরিত্র) মতো। এটা সে সজ্ঞানে করেনি। এরপর ওই জনক থেকে সন্তান তৈরি হলো। তাদের থেকে আবার সন্তান ও তাদের থেকে আবারও। এক কথায় সঠিক ডিজাইনের কারণে বংশবিস্তার কয়েক প্রজন্ম পর্যন্ত চলেছে।’
বোনগার্ড বলেন, ‘আমরা আবিষ্কার করেছিম অর্গানিজম বা কোনো কোষীয় জীবন ব্যবস্থার মধ্যে এমন সব জায়গা রয়েছে যার সম্বন্ধে আমরা জানতাম না। এর আগে আমরা হাঁটতে পারে এমন রোবট পেয়েছি। সাঁতরাতে পারে এমন রোবট পেয়েছি। আর এই গবেষণায় পেলাম এমন কিছু জেনোবট যারা নিজেদের প্রতিলিপি তৈরি করতে পারে।’
নতুন জেনোবটের সম্ভাবনা নিয়ে বোনগার্ড বলেন, ‘নতুন ওষুধ তৈরি করা বা পানি থেকে মাইক্রোপ্লাস্টিক পরিষ্কার করার কাজে এ যন্ত্রগুলোকে ব্যবহার করা যাবে। আমরা চাই যে হারে সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়, ঠিক একই হারে প্রযুক্তিগত সমাধান খুঁজে বের করতে।’
আরও পড়ুন: