‘প্রেম রাতান ধান পায়ো’ সিনেমার সুবাদে দীর্ঘ দিন পর পর্দায় ফিরেছেন প্রেমিক সালমান খান। ‘এক থা টাইগার’, ‘দাবাং’- এর মতো অ্যাকশন ছবির দাপটে দর্শক তো ভুলতেই বসেছিল ‘ম্যায়নে পেয়ার কিয়া’, ‘লাভ’, ‘হাম আপকে হ্যায় কৌন’, ‘ তেরে নাম’ ‘হাম দিল দে চুকে সনম’-এর আবেগী প্রেমিক সালমানকে।
অসংখ্য প্রেমের ছবির এ অভিনেতা ব্যক্তি জীবনেও প্রেমে পড়েছেন অনেক বার। কিন্তু কোনোবারই প্রেম পরিণয় অবধি গড়ায়নি।
মুম্বাইয়ের বান্দ্রায় সেন্ট স্তানিসলাস হাই স্কুলে পড়ার সময় সহপাঠী বন্ধুর বোনের প্রেমে পড়েন সালমান। সেই প্রেম কলেজ জীবন পর্যন্ত গড়ায়। তবে সেই প্রেমিকার বিষয়ে কখনো বিস্তারিত জানা যায়নি।
সালমান খানের প্রথম প্রেমিকা হিসেবে বরাবরই উচ্চারিত হয়েছে সংগীতা বিজলানির নাম। সংগীতা বিজলানি ১৯৮০ সালে মিস ইন্ডিয়া হয়েছিলেন। আশির দশকে মডেলিংয়ে সফল ক্যারিয়ার গড়ে চলচ্চিত্রে আসেন তিনি। ‘হাথিয়ার’, ‘ত্রিদেব’, ‘জুর্ম’, ‘ইজ্জাত’ – এর মতো ব্যাবসা সফল ছবির নায়িকা সংগীতা বয়সে ছিলেন সালমানের চেয়ে বছর পাঁচেকের বড়। আশির দশকের মাঝামাঝি থেকে নব্বইয়ের দশকের শুরু পর্যন্ত তাদের সম্পর্ক ছিল। সে সময় চলচ্চিত্রে মাত্র পা রেখেছেন সালমান। ১৯৮৯ সালে ‘ম্যায়নে পেয়ার কিয়া’র লাজুক প্রেমিক প্রেমের ভূমিকায় অভিনয় করে লাখো তরুণীর হৃদয়ের রাজা হয়ে বসেছেন। বোন আলভিরার মাধ্যমেই সংগীতার সঙ্গে পরিচয় হয় সালমানের। ১৯৯৩ সালে তাদের প্রেমে ভাঙন ধরে। ভারতীয় ক্রিকেট দলের সে সময়ের অধিনায়ক মোহাম্মদ আজহারউদ্দিনের সঙ্গে প্রেমই এই ভাঙনের কারণ বলে ধরা হয়। ১৯৯৬ সালে আজহারকে বিয়ে করেন সংগীতা।
পাকিস্তানি অভিনেত্রী সোমি আলির সঙ্গে সালমানের প্রেম শুরু হয় ১৯৯৩ সাল থেকে। সোমি ছিলেন বয়সে সালমানের দশ বছরের ছোট। তিনি বাবার দিক থেকে সালমানের দূর সম্পর্কের আত্মীয়াও ছিলেন। সোমির সঙ্গে সালমানের বিয়ের কথাও হয়। কিন্তু ১৯৯৭ সালে তাদের সম্পর্ক ভেঙে যায়। যুক্তরাষ্ট্রনিবাসী সোমি আলি বলিউডে কয়েকটি ছবিতে অভিনয় করলেও সাফল্য পাননি। পরবর্তীতে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে যান। তার নিজস্ব ফ্যাশন ডিজাইন হাউজ রয়েছে। তিনি একটি দাতব্য প্রতিষ্ঠানেরও প্রধান। সোমি আলির অভিযোগ ছিল সালমান অত্যন্ত বদমেজাজি এবং অতিরিক্ত মদ্যপান করেন।
‘হাম দিল দে চুকে সানাম’ ছবিতে অভিনয়ের সময় ১৯৯৯ সালে একে অপরের প্রেম পড়েন ঐশ্বরিয়া রাইয় ও সালমান। সে সময় তাদের সম্পর্ক দারুণ আলোচিত ছিল। ২০০২ সাল পর্যন্ত তাদের সম্পর্ক টিকেছিল। শোনা গিয়েছিল সালমান তার সঙ্গে দুর্ব্যবহার করতেন এবং শারীরিকভাবে আঘাত করতেন। ঐশ্বরিয়ার মা-বাবা এক সময় থানায় সালমানের বিরুদ্ধে অভিযোগও করেছিলেন। ঐশ্বরিয়ার বাসভবনের সামনে গিয়ে হট্টগোল করেছেন বলেও সালমানের নামে অভিযোগ করেন তারা।
২০০৩ সালে সালমানের জীবনে আসেন ক্যাটরিনা কাইফ। সালমান খানই সুন্দরী এই ইন্দো-ব্রিটিশ অভিনেত্রীকে বলিউডে প্রতিষ্ঠিত করেন। সালমানের বিপরীতে ‘ম্যায়নে পেয়ার কিউ কিয়া’ ছবির পর থেকেই তার ক্যারিয়ার চাঙা হয়ে ওঠে। তবে ২০১০ সালের দিকে তাদের সম্পর্ক ভেঙে যায়। শোনা যায় রানবির কাপুরের সঙ্গে ঘনিষ্টতার কারণেই সালমানের সঙ্গে তার প্রেমে ভাঙন ধরে। আবার এমন গুজবও রয়েছে যে জার্মান মডেল ক্লডিয়া সিয়াসেলার সঙ্গে সালমানের অতিরিক্ত মাখামাখির কারণেই ক্যাটরিনা তাকে ছেড়ে যান।
গত কয়েক বছর ধরে রোমানিয়ার অভিনেত্রী লুলিয়া ভ্যান্টুরের সঙ্গে সালমান খানের প্রেমের গুজব শোনা যাচ্ছে। বিশেষ করে সালমানের ছোট বোন অর্পিতার বিয়েতে খান পরিবারের সঙ্গে লুলিয়ার ঘনিষ্টতা চোখে পড়েছে আসরে উপস্থিত অতিথিদের। শোনা যায়, বিয়ের আসরেই লুলিয়াকে নিজের প্রেমিকা বলে পরিবারের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন সালমান। তবে সরাসরি এ সম্পর্কের কথা এখনও স্বীকার করেননি তিনি।
২০ বছর আগে কৃষ্ণ হরিণ শিকারের দায়ে পাঁচ বছরের কারাদন্ডের শাস্তি পাওয়া সালমান খান বিভিন্ন সময় নানারকম বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন।
আইন ভঙ্গ করার দায়ে বিভিন্ন সময় অভিযুক্ত হয়েছেন এই বলিউড তারকা। শুধু বিরল প্রজাতির প্রাণী শিকারই নয়, ২০০২ এ মুম্বাইয়ে গাড়ি দুর্ঘটনায় গৃহহীন চারজনকে আহত ও একজনকে হত্যার অভিযোগেও অভিযুক্ত হয়েছিলেন তিনি।
সাবেক প্রেমিকাদের শারীরিকভাবে লাঞ্ছনা করার অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
কিন্তু তারপরও সালমান খান ভারতের সবচেয়ে জনপ্রিয় সিনেমা তারকাদের মধ্যে একজন।
শিক্ষিত মধ্যবিত্ত থেকে শুরু করে শ্রমজীবি দরিদ্র শ্রেণী পর্যন্ত ভারতীয় সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয়তা রয়েছে তাঁর।
বিতর্কের সাথে বসবাস
কিন্তু জনপ্রিয় নায়কের পাশাপাশি বেপরোয়া জীবনযাপন করা উশৃঙ্খল এক সুপারস্টারের ভাবমূর্তিও তৈরী করেছেন তিনি।
তবে বিতর্ক আর দুর্ব্যবহারের অভিযোগ থাকলেও সালমানের ফ্যানরা সবসময়ই তাঁকে সমর্থন দিয়েছেন। এমনকি তাঁর ভক্তের সংখ্যা দিন দিন বেড়েছে।
ব্যবসায়িকভাবে দারুণ সফল সিনেমা তৈরীর পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও বিশাল জনপ্রিয়তা রয়েছে তাঁর।
সালমানের ফেসবুক পেইজে লাইকের সংখ্যা সাড়ে তিন কোটির বেশী। টুইটারে তাঁর অনুসরণকারীও সোয়া তিন কোটি।
কিন্তু খ্যাতনামা চিত্রনাট্যকার সেলিম খানের তিন ছেলের মধ্যে জেষ্ঠ্য সালমানের চরিত্রের অন্য দিকটিও বেশ সমালোচিত।
বিভিন্ন পার্টিতে তাঁর নানাধরনের কীর্তিকলাপ ও সহ-অভিনেত্রীদের সাথে তাঁর সম্পর্ক একসময় বলিউডের কানাঘুষার প্রধান উপাদান ছিল।
এমনও অভিযোগ আছে, এক রেস্টুরেন্টে ক্ষুদ্ধ হয়ে সাবেক এক প্রেমিকার মাথায় এক বোতল কোমল পানীয় ঢেলে দিয়েছিলেন তিনি।
অভিনেত্রী ও সাবেক মিজ ওয়ার্ল্ড ঐশ্বরিয়া রাইয়ের সাথে তাঁর সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ার পর ঐশ্বরিয়া অভিযোগ করেছিলেন যে সালমান তাঁকে শারীরিকভাবে আঘাত করেছে। সালমান খান এই অভিযোগ অস্বীকার করেন।
তবে এই ‘ব্যাড বয়’ ভাবমূর্তি কাটাতে গত কয়েক বছর নানাধরনের পদক্ষেপ নিয়েছেন এই অভিনেতা।
পরিবার ও ভাইদের প্রতি তাঁর ভালোবাসা ও দায়িত্ববোধের জন্য সবসমই প্রশংসিত সালমান খান। বন্ধুদের তো বটেই, কখনো কখনো অচেনা মানুষকে সাহায্য করতেও পিছপা হননা বলে সুনাম রয়েছে সালমানের।
সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের শিক্ষা ও চিকিৎসার উদ্দেশ্যে কয়েকবছর আগে তিনি ‘বিইং হিউম্যান’ নামের একটি দাতব্য প্রতিষ্ঠান শুরু করেন যারা টি-শার্ট ও অন্যান্য পণ্য বিক্রি করে মুনাফার টাকা দিয়ে দাতব্য কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে।
নারীদের সাথে সম্প্রতি তাঁর আচরণ অনেক পরিণত হলেও দুই বছর আগে কাজের ব্যস্ত সূচির উদাহরণ টানতে গিয়ে গিয়ে “ধর্ষিতা নারীর মত অনুভব হচ্ছে” বলে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েছিলেন তিনি।
আরেকটি পৃথক ঘটনায় তিনি বলেছিলেন যে ধূমপান, মদ্যপান ও কফির মত “দোষ” ছাড়তে পারলেও নারীলিপ্সা তিনি ছাড়তে পারবেন না।
এই ঘটনার পর ভারতের জাতীয় নারী কমিশন তাঁকে ক্ষমা চাওয়ার জন্য আদেশ দেয়।
সালমানের বাবা সেসময় বলেন মি.খানের এই উক্তি “যথাযথ নয়”। তাঁর ভাইয়েরা তার পক্ষ থেকে ক্ষমা চাইলেওে সালমান ক্ষমা চাইতে অস্বীকৃতি জানান।
নিজের আইনজীবির মাধ্যমে সালমান খান কমিশনকে জানিয়েছ যে তারা ‘এধরণের বিষয়ে কথা বলার অধিকার রাখে না’।
এখন পর্যন্ত বেশ কয়েকটি অপরাধমূলক কাজের অভিযোগে তাঁর বিরুদ্ধে হওয়া মামলায় শাস্তি পাওয়া থেকে অব্যাহতি পেয়েছেন তিনি।
আইনের সাথে খণ্ডযুদ্ধ
২০০২ সালের গাড়ি দুর্ঘটনার পর পালিয়ে যাওয়ায় ২০১৫’র মে মাসে তাঁকে পাঁচবছরের কারাদন্ডের শাস্তি দেয় আদালত।
তবে ঐ বছরের ডিসেম্বরেই উচ্চ আদালত এই রায় খারিজ করে দেয়। গতবছর ঐ মামলার বাদী সুপ্রীম কোর্টে আপিল করে। মামলাটি বর্তমানে সেখানে বিচারাধীন আছে।
ভারতের পশ্চিমাঞ্চলের রাজ্য রাজস্থানে ১৯৯৮ সালে কৃষ্ণা হরিণসহ সংরক্ষিত হরিণ শিকারের দায়ে অভিযুক্ত হন তিনি।
বৃহস্পতিবার আদালতের বিচারক তাঁকে ‘স্বভাবসিদ্ধ অপরাধী’ বলে আখ্যা দিয়ে পাঁচ বছরের কারাদন্ডের আদেশ দেন। তবে তাঁর দিন কয়েকের বেশী জেল খাটার সম্ভাবনা কম।
তাঁর আইনজীবিরা জানিয়েছেন তারা সালমানের জামিনের জন্য আবেদন করেছেন এবং এই রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল করবেন।
পাঁচ বছরের কারাদন্ড দেয়া হয়েছে সালমান খানকে
বিপন্নপ্রায় প্রাণী হত্যার দায়ে সালমানের বিরুদ্ধে করা চারটি মামালার দু’টিতে তিনি দোষী সাব্যস্ত হয়েছিলেন ২০০৬ সালে। সেবারও তাঁকে পাঁচ বছরের কারাদন্ড দেয়া হলেও এক সপ্তাহের মধ্যেই জামিনে ছাড়া পেয়ে যান তিনি।
২০১৬’র জুলাইয়ে রাজস্থানের হাইকোর্ট তাঁর দন্ডাদেশ বাতিল করে দেয়। এই রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রীম কোর্টে একটি আপিল করা হলেও কবে আদেশ আসবে তা নিশ্চিত নয়।