অপারেশন এন্টাবে থান্ডারবোল্ট: অভিযান : ইতিহাসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ এক কমান্ডো অভিযান

মিশরের শার্ম আল শেখ থেকে রাতের আঁধারে, সকলের চোখে ধুলো দিয়ে একত্রে আকাশে উড়লো চারটি সি-১৩০ হারকিউলিস বিমান। তাদের পেছন পেছন আকাশে উড়লো আরো দুটি বোয়িং-৭০৭ বিমান, যাদের একটির মধ্যে ছিল চিকিৎসা সামগ্রী আর অপরটিতে ছিলেন অপারেশনের সেনাপতি জেনারেল ইয়েকুতেই অ্যাডাম। বিমানগুলো লোহিত সাগরের উপর দিয়ে আন্তর্জাতিক আকাশসীমার মধ্য দিয়ে উড়ে চললো। তবুও মিশরীয়, সুদানিজ কিংবা সৌদি আরবের বিমান বাহিনীর রাডারে ধরা পড়লো না। কারণ রাডারের শনাক্তকরণ এড়াতে সেগুলো উড়েছিল সমুদ্রপৃষ্ঠের মাত্র ১০০ ফুট উপর দিয়ে!

আন্তর্জাতিক সময়ে তখন রাত এগারোটা বাজে। একটি সি-১৩০ অবতরণ করলো উগান্ডার এন্টাবে বিমানবন্দরে। চিকিৎসা সামগ্রী বহনকারী বিমানটি জ্বালানির জন্য অবতরণ করে কেনিয়ার নাইরোবি বিমানবন্দরে। একে পাহারা দিচ্ছিলো অপর তিনটি হারকিউলিস বিমান, যেগুলোর মধ্যে ছিল কমান্ডো সৈন্যদের কয়েকটি ইউনিট। আর জেনারেল অ্যাডামের বিমানটি এন্টাবে এয়ারপোর্টের উপরে আকাশে ঘুরপাক খাচ্ছিলো পুরো অপারেশন নজরদারি করতে। এদিকে কার্গো বিমানটির পেছনদিকের বিশাল দরজাটি অবতরণের আগেই খোলা হয়। কোনোরকম কালক্ষেপণ না করেই কার্গো থেকে নেমে আসে একটি সুদৃশ্য কালো মার্সিডিজ গাড়ি। গাড়িটি ঠিক উগান্ডার প্রেসিডেন্ট ইদি আমিনের গাড়ির মতোই! একই সময়ে এই গাড়ির সাথে যোগ দেয় আরো চারটি ল্যান্ড রোভার। গাড়িবহর ধীরে ধীরে এগোতে থাকে এন্টাবে বিমানবন্দরের পুরোনো টার্মিনালের দিকে, ঠিক যেভাবে ইদি আমিনের গাড়ি বহর এগোয় সেভাবে। তবে এই বহর প্রেসিডেন্টের গাড়িবহর ছিল না। গাড়িতে ছিল একদল ইসরায়েলি প্যারাকমান্ডো, যাদের নেতৃত্বে ছিলেন বর্তমান ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর বড় ভাই ইয়োনাথান নেতানিয়াহু।

এন্টাবে অপারেশনে ব্যবহৃত একটি সি-১৩০ হারকিউলিস বিমান; source: 20thcenturyaviationmagazine.com

এন্টাবে অপারেশনে ব্যবহৃত একটি সি-১৩০ হারকিউলিস বিমান; source: 20thcenturyaviationmagazine.com

প্রেসিডেন্টের গাড়িবহর দেখলে টার্মিনালের সিকিউরিটি গার্ডরা সহজেই ছেড়ে দেবে, এটাই তো হবার কথা। কিন্তু গার্ডদের স্পষ্ট মনে আছে যে কিছুদিন আগেই ইদি আমিন একটি সাদা মার্সিডিজ ব্যবহার করতে শুরু করেছেন। তাই কালো দেখেই সন্দেহ হলো। কিন্তু গাড়ি সার্চ করার আগেই সাইলেন্সার লাগানো রিভলভার থেকে গুলি করে নিঃশব্দে হত্যা করা হলো দুজন গার্ডকে। গাড়িবহর কোনো বিপত্তি ছাড়াই পুরনো টার্মিনালের দিকে এগোয়, যেখানে রয়েছে জিম্মিরা। আক্রমণের পরিকল্পনা পূর্বনির্ধারিত। কোনোরকম ভুলের অবকাশ নেই। একটু এদিক ওদিক হলেই মারা পড়তে পারে একাধিক জিম্মি। তাই কমান্ডোরা সবধরনের সতর্কতা অবলম্বন করলেন। অন্যদিকে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসা গাড়িবহরের কথা টেরও পায়নি হাইজ্যাকাররা। তার জানতো না যে খুব শীঘ্রই তারা মারা পড়তে যাচ্ছে।

এন্টাবে বিমানবন্দরের পুরনো টার্মিনাল ভবন। গুলির ছাপ এখনো স্পষ্ট; source: Wikimedia.Commons

এন্টাবে বিমানবন্দরের পুরনো টার্মিনাল ভবন। গুলির ছাপ এখনো স্পষ্ট; source: Wikimedia.Commons

গাড়িবহর টার্মিনালের কাছে পৌঁছামাত্র প্যারাকমান্ডোরা গাড়ি থেকে দ্রুত বাইরে নেমে আসে এবং ঝড়ের বেগে টার্মিনালের মেইন হলের দিকে এগিয়ে যায় যেখানে জিম্মিরা ছিল। মেইন হলে গিয়েই তারা মাইকে ইংরেজি এবং হিব্রুতে জিম্মিদেরকে মাটিতে শুয়ে পড়ার আহ্বান জানায় এবং নিজেদের পরিচয় দিয়ে আশ্বস্ত করে। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে এক ফরাসি যুবক ইংরেজি বা হিব্রু কোনোটিই জানতো না এবং হুট করে দাঁড়িয়ে যায়। কমান্ডোরা তাকে হাইজ্যাকার মনে করে মুহূর্তে গুলি করে হত্যা করে। এরই মাঝে অপহরণকারীদের একজন, উইলফ্রেড বোস মেইন হলে প্রবেশ করে এবং কমান্ডোদের দিকে গুলি চালায়। কমান্ডোরা পাল্টা গুলি করে বোসকে হত্যা করে। শ্বাসরুদ্ধকর গোলাগুলি চলে ত্রিশ মিনিট যাবত। মেইন হলে চারজনকে হত্যা করে পাশের কামরায় থাকা বাকি তিন সন্ত্রাসীকেও গুলি করে হত্যা করে কমান্ডোরা। গোলাগুলির প্রচণ্ড শব্দে দিশেহারা হয়ে একজন জিম্মি দৌড়ে টার্মিনালের বাইরে বেরোতে গেলে হাইজ্যাকারদের গুলিতে নিহত হয়। আহত হয় আরো এক জিম্মি। আর এরই সাথে সফলভাবে শেষ হয় অপারেশন ‘রেইড অন এন্টাবে’। ১০২ জন বন্দীকে অক্ষত শরীরে উদ্ধার করা হয়। তবে নাটকের শেষটা তখনও বাকি!

এই মার্সিডিজ গাড়িটিই ব্যবহার করা হয়েছিল ইদি আমিনের গাড়ি হিসেবে ধোঁকা দিতে; source: Ynetnews.com

এই মার্সিডিজ গাড়িটিই ব্যবহার করা হয়েছিল ইদি আমিনের গাড়ি হিসেবে ধোঁকা দিতে; source: Ynetnews.com

ঘটনার সূত্রপাত ইতিহাসের বৃহত্তম বিমান ছিনতাই থেকে। ১৯৭৬ সালের ২৭ জুন ইসরায়েলের তেল আবিব বিমানবন্দর থেকে ২৪৬ জন যাত্রী ও ১২ জন ক্রু নিয়ে উড্ডয়ন করে ‘এয়ার ফ্রান্স ফ্লাইট-১৩৯’। যাত্রাপথে গ্রীসের এথেন্স বিমানবন্দর থেকে আরো ৫৮ জন যাত্রী তোলে বিমানটি। এথেন্স থেকে রওনা হয় প্যারিসের উদ্দেশে। কিন্তু এই ৫৮ জনের মাঝে দুর্ভাগ্যক্রমে চারজন সন্ত্রাসী ছিল। এদের দুজন ‘পপুলার ফ্রন্ট ফর লিবারেশন অব প্যালেস্টাইন’ এর সদস্য। অন্য দুজন জার্মানির গেরিলা সংগঠন ‘রেভ্যুলশনারি সেলস’ এর গেরিলা যোদ্ধা উইলফ্রিড বোস এবং ব্রিজিত কুলমান। উড্ডয়নের মাত্র ১৫ মিনিটের মাথায় হাইজ্যাকাররা বিমানের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয় এবং প্যারিসের বদলে লিবিয়ার বেনগাজিতে চলে যায়। সেখানে জ্বালানি সরবরাহের পর পুনরায় আকাশে উড়ে ফ্লাইট-১৩৯ এবং ২৮ জুন উগান্ডার এন্টাবেতে গিয়ে পৌঁছে।

সফল অভিযান শেষে ইসরায়েল পৌঁছানোর পর বিমানবন্দরে উল্লাসে মেতে ওঠে সাধারণ মানুষ ও জিম্মিদের আত্মীয়-স্বজনেরা; source: Star.kiw

সফল অভিযান শেষে ইসরায়েল পৌঁছানোর পর বিমানবন্দরে উল্লাসে মেতে ওঠে সাধারণ মানুষ ও জিম্মিদের আত্মীয়-স্বজনেরা; source: Star.kiwi

এন্টাবেতে উগান্ডান বাহিনী হাইজ্যাকারদের সহায়তা করে। আরো তিনজন হাইজ্যাকারের সাথে যোগ দেয়ার জন্য অপেক্ষারত ছিল সেখানে। তারা জিম্মিদের এন্টাবে বিমানবন্দরের পরিত্যক্ত টার্মিনাল ভবনে সরিয়ে নেয় এবং সেখানে প্রহরায় রাখে। ইদি আমিন তখন প্রতিদিনই একবার এসে হাইজ্যাকারদের সাথে দেখা করে যেতেন। সেদিনই সন্ধ্যায় তারা বন্দীদের মুক্তির দুটি শর্ত উপস্থাপন করে।

  • ফ্লাইট-১৩৯ বিমানের জন্য পাঁচ মিলিয়ন মার্কিন ডলার মুক্তিপণ।
  • ইসরায়েলের কারাগারে বন্দী ৪০ জন সহ মোট ৫৩ জন বন্দীর মুক্তি।
  • ১ জুলাইয়ের মধ্যে শর্ত পূরণ না হলে জিম্মিদের হত্যা করা শুরু হবে।

অপহৃত হওয়া সেই ফরাসি বিমানটি; source: commons.wikimedia.org

অপহৃত হওয়া সেই ফরাসি বিমানটি; source: commons.wikimedia.org

এই বিমান অপহরণ এবং জিম্মির ঘটনায় বিশ্ব রাজনীতি ততদিনে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। ইউরোপিয়ান দেশগুলো ইসরায়েলের পাশে দাঁড়ানোর প্রতিশ্রুতি দিলেও আরব দেশগুলো ছিল নিশ্চুপ। এরই মাঝে এই শর্তগুলো প্রকাশিত হলে দ্রুত দর কষাকষি শুরু করে ইসরায়েলি মন্ত্রীসভা। তবে অপহরণের ৪৮ ঘন্টা পর, ৩০ জুন ঠিক ৪৮ জন জিম্মিকে মুক্তি দেয় অপহরণকারীরা। এই ৪৮ জনের কেউই ইসরায়েলি কিংবা ইহুদি ছিল না। এদিকে পহেলা জুলাই চলে আসলেও ইসরায়েলি মন্ত্রীসভা কোনো নীতিগত সিদ্ধান্তে পৌঁছুতে পারেনি। তারা তৎকালীন মিশরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত এবং ফিলিস্তিন প্রেসিডেন্ট ইয়াসির আরাফাতের মাধ্যমে ইদি আমিনের সাথে কূটনৈতিক আলাপ আলোচনা করেন। তাতেও কাজ না হলে ইসরায়েল সরকার ১ জুলাই অতিরিক্ত সময়ের আবেদন করে অপহরণকারীদের নিকট। অপহরণকারীরা ইদি আমিনের অনুরোধে এই সময় ৪ জুলাই বিকাল পর্যন্ত বর্ধিত করে এবং একইসাথে আরো ১০০ অ-ইসরায়েলিকে মুক্তি প্রদান করে। এই ১০০ জনের মধ্যে ৯৯ জনকে সেদিনই প্যারিস নিয়ে যাওয়া হয়। ডোরা ব্লচ নামক একজন ব্রিটিশ ইহুদীকে অসুস্থতার জন্য প্যারিস না পাঠিয়ে কাম্পালার এক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

১ জুলাই ইসরায়েলের বিভিন্ন গণমাধ্যমে খবর বের হয় যে মন্ত্রিসভা বন্দীদের মুক্তি দেয়ার সিদ্ধান্ত নিতে চলেছে। এই গুজবের সত্যতা যদিও জানা যায় না, তবে সিনেমার দুর্দান্ত সব সেনা অভিযানের মতোই এক দুঃসাহসিক উদ্ধার অভিযানের পরিকল্পনা নিয়ে হাজির হয় মোসাদ। হ্যাঁ, পৃথিবীর সবচেয়ে দুর্ধর্ষ গোয়েন্দা সংস্থা মন্ত্রিসভাকে আশ্বস্ত করে যে তারা জিম্মিদের মুক্ত করে নিয়ে আসতে নিখুঁত এক পরিকল্পনা প্রস্তুত করেছে। তাদের পরিকল্পনায় ১০০ জন প্যারাকমান্ডো যোগ দেবে ইতিহাসের অন্যতম দুঃসাহসিক উদ্ধার অভিযানে।

অভিযানের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে দুটি বিষয়, তা হচ্ছে বন্দীদের সঠিক অবস্থান এবং হাইজ্যাকারদের নির্ভুল সংখ্যা। এক্ষেত্রে মোসাদ তাদের অবিশ্বাস্য নৈপুণ্য প্রদর্শন করে। তারা টার্মিনাল ভবনের নকশা উপস্থিত করে এবং হাইজ্যাকারদের সংখ্যা নিশ্চিত করে। এ দুটো নিশ্চিত হবার পর বাকি কাজটা কমান্ডোদের জন্য সহজ হয়ে যায়। চারটি সি-১৩০ কার্গো বিমান এবং দুটি বোয়িং-৭০৭ বিমান নেয়া হয়। মোট ১০০ জন কমান্ডো সদস্য এন্টাবেতে গেলেও তাদের মধ্যে ২৯ জনের একটি অ্যাসাল্ট ইউনিটই মূল অপারেশন পরিচালনা করে। এই ইউনিটের নেতৃত্বে ছিলেন ইয়োনাথান নেতানিয়াহু। উগান্ডান বাহিনীর আক্রমণ থেকে এই ইউনিটকে রক্ষা করার জন্য কর্ণেল মাতান, কর্ণেল উরি এবং মেজর শলের নেতৃত্বে আরো তিনটি ইউনিট উপস্থিত ছিল এন্টাবেতে। তাছাড়া আকাশে এন্টাবেকে প্রদক্ষিণ করতে থাকা একটি বোয়িং এ জেনারেল অ্যাডাম ছাড়াও ছিলেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ড্যান শরমন, যিনি এই পুরো অভিযানের সার্বিক পরিচালনার দায়িত্ব পালন করেন।

ইয়োনাথান নেতানিয়াহু; source: Indiatimes.com

ইয়োনাথান নেতানিয়াহু; source: Indiatimes.com

অপারেশন সফল হলে কমান্ডোরা দ্রুত জিম্মিদের বিমানে তুলতে থাকে। এ সময় তারা উগান্ডার বেশ কিছু মিগ বিমান ধ্বংস করে দেয়, যেন উগান্ডান বিমান বাহিনী তাদের পিছু নিতে না পারে। তবে জিম্মিদের বিমানে তোলা শেষ হবার আগেই তাদের লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়তে শুরু করে উগান্ডার সেনাবাহিনীর কিছু সদস্য। শুরু হয় দ্বিতীয় দফায় গোলাগুলি। এবার আগেরবারের চেয়ে আরো কম সময় গোলাগুলি চলে। তবে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ছিল বেশি। ৪৫ জন উগান্ডান সেনা সদস্য মারা যায়। কমান্ডোদের অ্যাসাল্ট ইউনিটের প্রধান ইয়োনাথান নেতানিয়াহু মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। আহত হয় আরো পাঁচ কমান্ডো সদস্য। সবাইকে বিমানে ওঠানো শেষ হলে কমান্ডোরা এন্টাবে ছেড়ে ইসরায়েলের উদ্দেশে যাত্রা করে।

ইয়োনাথান নেতানিয়াহু; source: Indiatimes.com

উগান্ডার একটি ধ্বংসপ্রাপ্ত মিগ বিমান; source: newvision.co.ug

এই অভিযানে ক্ষিপ্ত হয়ে উগান্ডান কয়েকজন সেনা সদস্য কাম্পালায় থাকা সেই ব্রিটিশ ইহুদী ডোরাহ ব্লচকে হত্যা করে। পাঁচদিন পর, ৯ জুলাই, ১৯৭৬ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের বৈঠক বসে। সেখানে ইসরায়েলকে নিজেদের সার্বভৌমত্বের লঙ্ঘনকারী বলে অভিহিত করেন উগান্ডার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওরিস আবদুল্লাহ। তৎকালীন জাতিসংঘের মহাসচিব কুর্ট ওয়াল্ডহেইমও এই ঘটনাকে একটি সদস্য রাষ্ট্রের ‘সার্বভৌমত্বের লঙ্ঘন বলে ঘোষণা দেন। লিবিয়া, বেনিন, তানজানিয়া, মিশর এই অভিযানের সমালোচনা করে। ইউরোপীয় দেশগুলো অন্যদিকে এই অভিযানকে প্রয়োজনীয়তা বলে উল্লেখ করে।

অপারেশন ‘রেইড অন এন্টাবে’র যাবতীয় ক্ষয়ক্ষতির তালিকা-

  • তিনজন জিম্মি মারা যায় এবং আহত হয় ১০ জন।
  • হাইজ্যাকারদের সাতজনই মারা যায়।
  • কমান্ডো বাহিনীর একজন মারা যায়, পাঁচজন আহত হয়।
  • ৪৫ জন উগান্ডান সেনা সদস্য মারা যায়, ধ্বংস হয় ৩০টি সোভিয়েত নির্মিত মিগ বিমান।

ক্ষয়ক্ষতি আর তাৎক্ষণিক বিশ্ব জনমত, সবকিছু ইসরায়েলের পক্ষেই ছিল। মাঝে হাইজ্যাকারদের সাথে মিত্রতা রাখতে গিয়ে অধিক ক্ষতির সম্মুখীন হয় উগান্ডা। তবে সবকিছু বিবেচনা করে এই অপারেশনকে পৃথিবীর ইতিহাসে অন্যতম শ্রেষ্ঠ উদ্ধার অপারেশন বলে গৌরবান্বিত করা হয়। তৎকালীন প্রায় সকল শক্তিশালী দেশই এই অভিযানের প্রশংসা করে এবং বিস্ময়ও প্রকাশ করে বটে। আমেরিকান সেনাবাহিনীর কমান্ডো অপারেশন ‘অপারেশন ঈগল ক্ল’ এই এন্টাবে অপারেশন দ্বারাই উদ্বুদ্ধ হয়। তবে ঈগল ক্ল ব্যর্থ হয়েছিল। তথাপি ‘রেইড অন এন্টাবে’ সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের এক সাহসী দৃষ্টান্ত হিসেবে যুগে যুগে অনুপ্রেরণা যোগাবে।

অপারেশন থান্ডারবোল্ট! ইতিহাস সেরা এক কমান্ডো অপারেশনের গল্প।
২৭ জুন – ১৯৭৬।
এয়ার ফ্রান্স ফ্লাইট ওয়ান_থ্রি_নাইন তেলআবিব বিমানবন্দর থেকে আকাশে ভেসে উঠে।তেলআবিব থেকে প্যারিস পর্যন্ত এই যাত্রায় ফ্লাইট ১৩৯ বহন করবে সর্বমোট ৩১৬ জন যাত্রী।যাত্রার এক স্টপেজে সেটা ২৬০ জনের যাত্রায় পরিণত হবে।তেলআবিব থেকে তুলে আনা ২৪৬ জন মূলত ইহুদি ও ইসরায়েলি পাসপোর্টধারী।এদের একাংশ এথেন্সে নেমে যাবেন এবং এথেন্স থেকে নতুন আরো ৫৮ জন আরোহী টেকঅফ করবেন।সব পরিকল্পনা মাফিক চললে ফ্লাইট ওয়ান_থ্রি_নাইন প্যারিস শার্ল দ্য গল ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে অবতরণ করবে ২৬০ জন অন বোর্ড প্যাসেন্জার নিয়ে।
কিন্তু,অবশেষে সবকিছু পরিকল্পিত ভাবে হলো না।
এথেন্স থেকে এয়ার ফ্রান্সের ফ্লাইট ১৩৯ (যেটি ছিলো একটি এয়ারবাস এ-৩০০) টেকঅফ করার পরপরই গ্রীসের আকাশে ফিলিস্তিনের একটি মুক্তিকামী সশস্ত্র দল ও জার্মান বামপন্থী বাদের মেইনহফ গোষ্ঠী এর একদল সশস্ত্র যোদ্ধা বিমানের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে।উভয় সংস্থা থেকে ২জন করে সর্বমোট চার হাইজ্যাকার বিমানটি দখলে নিয়েছিল।
প্যারিসের রুট ধরে উড়ন্ত বিমানের নাক হাইজ্যাকাররা বেনগাজী এর দিকে ঘুরিয়ে দেয়।লিবিয়ার বেনগাজী বা বেনিনা ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে ০৭ ঘন্টা যাবত বিমানটি অবস্থান করে।এসময় বিমান থেকে প্যাট্রিসিয়া মার্টেল নামক ব্রিটিশ বংশোদ্ভূত ইসরায়েলি তরুণিকে ছেড়ে দেওয়া হয়।যার মিসক্যারেজ হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছিলো।
এর ২৪ ঘন্টা পর ফ্লাইট ওয়ান_থ্রি_নাইন এর নতুন নিয়ন্ত্রকদের পূর্ব নির্ধারিত গন্তব্য তথা উগান্ডার এন্টিবি এয়ারপোর্টে অবতরণ করে।এখানে অবতরণের সাথে সাথেই বিমানের নিয়ন্ত্রণে থাকা সশস্ত্র যোদ্ধার সংখ্যা ০৪ থেকে ০৮ এ উপনীত হয়।তবে,আসলে এই ক্ষুদ্র সশস্ত্র দলটিকে উগান্ডার প্রেসিডেন্ট ইদি আমিন প্রায় প্রত্যক্ষ সহযোগিতা দিচ্ছিলেন।তার সেনাসদস্যরা প্রত্যক্ষভাবেই ০৮ জনের বিপ্লবী গ্রুপের সাহায্য করছিলো।ফলে,তাঁদের আসল সংখ্যা আর ক্ষুদ্র ০৮ ছিলো না।
উগান্ডার সামরিক বাহিনীর সহায়তায় বিপ্লবী হাইজ্যাকাররা যাত্রীদের এন্টিবি এয়ারপোর্টের একটি পরিত্যক্ত টার্মিনালের ট্রানজিট হলে জড়ো করে।
আনুষ্ঠানিক দাবি জানানো হলো –
২৮ জুন- ১৯৭৬।ফিলিস্তিনি গ্রুপের পক্ষ থেকে একটি বার্তা ছড়িয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা হয়।যেখানে বলা হয়েছিলো – “বিমান ও এর যাত্রীদের জীবনের বিনিময়ে যদি ০৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং ইসরায়েলের কারাগারে থাকা ৫৩ জন ফিলিস্তিনি সংগ্রামী যোদ্ধার মুক্তি দেওয়া হয়,সেক্ষেত্রে এই ঘটনার সমাপ্তি ঘটবে।” সাথে সাথে সতর্ক করে দেওয়া হয় যে,পহেলা জুলাইয়ের ভেতর দাবি না মেটানো হলে একইদিন থেকে জিম্মি ইসরায়েলি ও ইহুদিদের জীবন নেওয়া আরম্ভ করা হবে।
এই বার্তা পাওয়ার পরপরই ইসরায়েলের সামরিক বাহিনীর হাই-কমান্ড এবং ক্ষমতাসীন নেতারা চিন্তামগ্ন হতে শুরু করলেন।
নেগোসিয়েশন নাকি মিলিটারি অপারেশন?এন্টিবি ইসরায়েল হতে প্রায় ৫০০০ কিলোমিটার দূরে।
এদিকে ২৯শে জুন আসতেই বিপ্লবীরা ইসরায়েলি যাত্রীদের বাকিদের থেকে আলাদা করে ফেলতে শুরু করে।একই সাথে যারা ইসরায়েলি নয়,এমন জিম্মিদের ছেড়ে দিতে থাকে।যা ছিল তাদের ভুল সিদ্ধান্ত।এমনই এক প্রক্রিয়ায়,ইসরায়েল সেনাবাহিনীর সাবেক একজন কর্মকর্তা জিম্মিদশা থেকে মুক্তি পেয়ে যায়,এবং পরবর্তীতে মোসাদকে যথেষ্ট তথ্য ও উপাত্ত সরবরাহ করে।
সাধারণত,এধরণের হাইজ্যাক মিশনে হাইজ্যাকাররা যতই সরকারপক্ষকে সময় বেশি দেয়,ততই তাদের সাফল্যের সম্ভাবনা কমতে থাকে।ইসরায়েল সরকার উগান্ডার প্রেসিডেন্ট ইদি আমিনের মাধ্যমে বিপ্লবীদের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করে।ইদি আমিন সশরীরে তখন নিয়মিত হাইজ্যাকারদের সাথে সাক্ষাৎ করতেন এবং বন্দীদের আশ্বাসবাণী শুনিয়ে আসতেন।ইদি আমিনের মাধ্যমে ইসরায়েল ০৪ জুলাই পর্যন্ত সময় আদায় করে নেয়।এরই মধ্যে ইসরায়েলি পাসপোর্টধারী নয় এমন আরো একদলকে ছেড়ে দেওয়া হয়।সবমিলিয়ে এখন রয়ে গেলো ১০৬ জন।১২ জন ফ্লাইট ক্রু ( যারা বিমানযাত্রীদের ত্যাগ করতে অস্বীকার করে) ,প্রায় ১০ জন ফ্রেঞ্চ এবং ৮৪ জন ইসরায়েলি ছিলেন তাদের অন্তর্গত।
মিলিটারি অপারেশন লঞ্চড-অপারেশন থান্ডারবোল্ট
-বাকি অংশ পড়তে চোখ রাখুন আজ বিকেল ৪ টায়।

ফিচার ছবি: WallpaperLists.COM

Leave a Reply