শীলভদ্র :সপ্তম শতকের জগদ্বিখ্যাত বাঙালি পণ্ডিত

আচার্য শীলভদ্র
সপ্তম শতকের জগিবখ্যাত বাঙালি পণ্ডিত। প্রাচীন বাংলায় বা প্রাচীন বঙ্গদেশে যেসকল বাঙালি তাঁদের কর্মপ্রতিভা দিয়ে বিশ্বসমাজে কৃতিত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন, তাঁদের মধ্যে শীলভদ্র সকলের চেয়ে প্রখ্যাত। বাংলাদেশের ইতিহাসে শীলভদ্রের আগে তাঁর মতো এত বড়মাপের উচ্চশিক্ষিত বাঙালি পণ্ডিতের নাম জানা যায় না। শীলভদ্র ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন মহান শিক্ষক এবং শিক্ষাবিদ, শিক্ষা সংগঠক, মহাজ্ঞানী ও শাস্ত্রজ্ঞ-দার্শনিক। তত্সময়ে ভারতের সর্বশ্রেষ্ঠ পণ্ডিত হিসেবে তাঁকে বর্তমানে বিবেচনা করা হয়। সপ্তম শতাব্দী থেকে বর্তমান অবধি মহাস্থবির শীলভদ্রের নাম চলে এসেছে তাঁর অমর খ্যাতির গুণে।
প্রাচীন ভারতে বর্তমান বিহার প্রদেশে অবস্থিত নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান আচার্য বা চ্যান্সেলরের পদে শীলভদ্র ২০ বছরের বেশি দায়িত্ব পালন করেন। প্রাচীন বাংলার ‘সমতট’ রাজ্যে বর্তমান কুমিল্লা জেলার অধিবাসী বিশ্ববিশ্রুত এই পণ্ডিত চান্দিনা থানার কৈলান গ্রামে ৫২৯ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন এবং মৃত্যুবরণ ৬৫৪ খ্রিস্টাব্দে। মহাস্থবির শীলভদ্র গুপ্ত শাসন যুগের মানুষ এবং বৌদ্ধজগতের মহাপণ্ডিত। তিনি ‘সমতট’ রাজ্যের ব্রাহ্মণ রাজপরিবার ভদ্রবংশের সন্তান। ত্রিপুরার মহারাজা ঐতিহাসিক শ্রী কৈলাসচন্দ্র সিংহ (জন্ম-১৮৫১ মৃত্যু-১৯১৪) তাঁকে ‘সমগ্র বাঙালি জাতির আদি গৌরবস্তম্ভ’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। প্রায় দেড়শত বছর আগে ১২৮৩ বঙ্গাব্দে ‘রাজমালা বা ত্রিপুরার ইতিবৃত্ত’ (প্রাচীন কুমিল্লার ইতিহাস) ক্ষুদ্র গ্রন্থে তিনি এই অভিমত রাখেন, এই ক্ষুদ্র গ্রন্থটি পরে ‘রাজমালা বা ত্রিপুরার ইতিহাস’ নামে বর্ধিত কলেবরে পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থ ত্রিপুরার আগরতলা থেকে প্রকাশিত হয় আশ্বিন, ১৩০৩ বঙ্গাব্দে। এর দু’বছর আগে কলকাতার বিখ্যাত সংবাদপত্র মাসিক ‘সাহিত্য’তে ১৩০১ বঙ্গাব্দে বৈশাখ সংখ্যায় ‘বঙ্গের আদিগৌরব শীলভদ্র’ শিরোনামে তিনি এক দীর্ঘ নিবন্ধ লেখেন, যাতে শীলভদ্রের বর্ণাঢ্য জীবন ও কর্ম বিশেষভাবে বিধৃত হয়েছে। বিশেষত, কৈলাসচন্দ্র সিংহের এই লেখার কারণে তখনকার বাঙালি সমাজে পণ্ডিত শীলভদ্র বিশেষভাবে সমাদৃত হন।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জ্ঞানের জগত্ও শীলভদ্রের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে। কবিগুরু অশেষ শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন প্রাচীন বাংলার এই মহান পণ্ডিতের প্রতি। ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের রূপ’ প্রবন্ধে এক আত্মিক মর্যাদায় কবিগুরু বলেন, ‘বাংলাদেশের পক্ষ থেকে আরও একটি কথা আমাদের মনে রাখবার যোগ্য। নালন্দায় হিউয়েন সাঙ-এর যিনি গুরু ছিলেন তিনি ছিলেন বাঙালী; তাঁর নাম শীলভদ্র। তিনি বাংলাদেশের কোনো এক স্থানের রাজা ছিলেন, রাজ্য ত্যাগ করে তিনি বেরিয়ে আসেন। এই সঙ্গে যাঁরা শিক্ষাদান করতেন তাঁদের সকলের মধ্যে একলা কেবল ইনিই সমগ্র শাস্ত্র সমস্ত সূত্র ব্যাখ্যা করতে পারতেন।’
শীলভদ্র সম্পর্কে জানার প্রধান উপায় বিখ্যাত চৈনিক পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙ (Hieun Tsang)-এর বিবরণী। তাঁর গ্রন্থে স্থান না পেলে শীলভদ্র সম্পর্কে কোনোকালেই জানা হয়তো সম্ভব হতো না। হিউয়েন সাঙ প্রাচীন নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ে শীলভদ্রের ছাত্র ছিলেন। উভয়ে উভয়ের জীবনঘনিষ্ঠ; পিতা-পুত্রের সম্পর্কসম। হিউয়েন সাঙ ভারত থেকে নিজ দেশে প্রত্যাগমন করে চীন সম্রাটের অনুরোধে বৌদ্ধধর্ম ও ভারত ভ্রমণের বিবরণ সম্বলিত ‘সি ইউ কি’ নামক তথ্যবহুল একটি গ্রন্থ চীনা ভাষায় রচনা করেন। ‘সি ইউ কি’ গ্রন্থটি আধুনিককালে চীনে ব্রিটেনের সাবেক রাষ্ট্রদূত স্যামুয়েল বিল কর্তৃক বইটি ইংরেজিতে অনূদিত হয়। প্রসঙ্গক্রমে বলা প্রয়োজন যে, হিউয়েন সাঙের বর্ণনায় প্রাচীন বাংলাদেশসহ প্রাচীন ভারতবর্ষের ভৌগলিক ও সামাজিক, রাজ-ইতিহাস ও সাস্কৃতিক চিত্র সুনিপুণভাবে ফুটে উঠেছে। তাঁর বর্ণনার মুখ্য বিষয় হলো, ভারতসহ বিভিন্ন জনপদের নামকরণ, দেশের পরিমাণ, নগর ও গৃহাদির বিবরণ, পোশাক-পরিচ্ছদ, লিপি-ভাষা-বিদ্যা ও গ্রন্থের বিবরণ, শিক্ষা, সামাজিক প্রথা, আচার-ব্যবহার, শাসনপ্রথা ও রাজস্বাদির পরিচয়, এমনকি গাছপালা, খাদ্যদ্রব্য, তৈজসপত্র বা রত্নরাজিদেরও তিনি পরিচয় দিয়েছেন।
সমতট তথা সে-সময়ের কুমিল্লা সম্পর্কে হিউয়েন সাঙের জীবন্ত বর্ণনা এরকম : এখানে নিয়মিত চাষাবাদ হয়। প্রচুর শস্য আর ফলমূল সর্বত্রই জন্মায়। আবহাওয়া নাতিশীতোষ্ণ আর লোকদের স্বভাব হচ্ছে ভদ্র। এখানকার মানুষ পরিশ্রমী, লম্বায় কম আর এদের গায়ের রং কালো। এরা প্রবল বিদ্যানুরাগী আর বিদ্যালাভ করার জন্য যথেষ্ট পরিশ্রম করে। সত্য আর মিথ্যা এই দুই সিদ্ধান্তেরই লোক এখানে থাকে।’ কুমিল্লার লালমাই-ময়নামতি অঞ্চলে ২টি বড় বিহারসহ ছোট-বড় ৩৫টি বিহার দেখেছেন বলেও হিউয়েন সাঙ উল্লেখ করেন এবং এ স্থানকে তিনি ‘দি সিটি অব দ্যা ইউনিভার্সিটি’ বা ‘বিশ্ববিদ্যালয় নগরী’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। বাংলাদেশে মুসলিম বিজয়ের পূর্বেকার ভারত তথা বাংলাদেশের ধারাবাহিক লিখিত ইতিহাস খুব একটা পাওয়া যায় না, সে কারণে হিউয়েন সাঙের মতো জগত্খ্যাত বিদেশি মনীষীদের প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে লিখিত বিবরণ আধুনিক পণ্ডিতদের কাছে বিশুদ্ধ ইতিহাস গ্রন্থ হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে।
শীলভদ্র শৈশবেই জ্ঞান অন্বেষণে গভীর অনুরাগী ছিলেন। ২০ বছর বয়স পর্যন্ত সমতট রাজ্যের রাজধানী বা প্রধান কেন্দ্র অর্থাত্ লালমাই-ময়নামতিতে অবস্থান করেন; প্রারম্ভ শিক্ষা সেখানেই। নিজ রাজ্যের শিক্ষায় পুরোপুরি জ্ঞানপিপাসা মেটাতে পারেননি। তাই কৈশরোত্তীর্ণ তরুণ শীলভদ্র রাজকীয় সম্মান ও ঐশ্বর্য ত্যাগ করে অধিকতর জ্ঞান অন্বেষণের জন্য ভারতবর্ষের বহু শিক্ষাকেন্দ্র পরিভ্রমণ করে বৌদ্ধধর্মসহ সর্বজনীন শিক্ষায় তিনি সুশিক্ষিত হয়ে ওঠেন। তিরিশ বছর বয়সে তিনি ভারতের নালন্দায় উপস্থিত হয়ে সেখানকার ছাত্র হন। নালন্দায় যখন শীলভদ্র ছাত্র হিসেবে ভর্তি হন তখন এই প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠার বয়স ছয় শত বছর পেরিয়েছে। তখন নালন্দা মহাবিহারের বোধিসত্ত্ব ধর্মপাল। ধর্মপাল যোগাচার (বিজ্ঞানবাদ) দর্শনের একজন অসাধারণ পণ্ডিত ছিলেন। ধর্মপালের সরাসরি ছাত্র হওয়ার সুবাধে তাঁর সংস্পর্শে এসে শীলভদ্র অনুরক্ত শিষ্য হন এবং নানা বিষয়ে দীক্ষা লাভ করেন। ধর্মপালের নিকট থেকে বৌদ্ধধর্মের প্রাঞ্জল ব্যাখ্যা শুনে শীলভদ্র মুগ্ধ হন। ধর্মপালের ধর্মজ্ঞান ও ব্যক্তিগত গুণাবলি অতি সহজেই শীলভদ্র আয়ত্ত করে নেন।
শীলভদ্রের পাণ্ডিত্যের খ্যাতি তখন দূরদেশেও ছড়িয়ে পড়েছে। ওই সময় দাক্ষিণাত্যের একজন দিগিবজয়ী ব্রাহ্মণ পণ্ডিত মগধ রাজ্যের (ভারতের বর্তমান বিহার এলাকা) রাজার দরবারে হাজির হন। ধর্ম বিষয়ে ধর্মপালের সাথে তর্কযুদ্ধে লিপ্ত হওয়ার জন্য প্রস্তাব দাখিল করেন। মগধ রাজা তখন ধর্মপালকে তলব করেন। ধর্মপাল তখন রাজদরবারে গমন করার প্রস্তুতি নিলেন। এমন সময় শীলভদ্র নিজেই তর্কযুদ্ধে লিপ্ত হতে আগ্রহ প্রকাশ করেন এবং তাঁকে সুযোগ দেয়ার জন্য ধর্মপালকে অনুরোধ করেন। ধর্মপাল বলেন, ‘বৌদ্ধধর্মের সূর্য অস্তমিত হতে চলেছে। চারদিকে বিধর্মীরা মেঘের মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে। তাদের দূর করতে না পারলে সত্ ধর্মের কোনো উন্নতি নেই।’ শীলভদ্র আবার বললেন, ‘গুরুদেব, আপনি অবস্থান করুন। আমি সেই সভায় গমন করছি।’ রাজদরবারে হাজির হলেন শীলভদ্র। তাঁকে দেখার পর দাক্ষিণাত্যের ব্রাহ্মণ পণ্ডিত তাচ্ছিল্য করলেন। কিন্ত অল্পক্ষণের মধ্যেই ব্রাহ্মণ পণ্ডিতকে তর্কযুদ্ধে পরাজিত করেন শীলভদ্র। কোনো যুক্তির খণ্ডন কিংবা বচনের উত্তর দিতে না পেরে পণ্ডিত লজ্জিত অবস্থায় রাজদরবার ত্যাগ করেন। শীলভদ্রের অসাধারণ পাণ্ডিত্য ও বাগ্মিতায় মুগ্ধ হয়ে মগধ রাজা শীলভদ্রকে একটি নগরের রাজস্ব উপহার দিলেন। শীলভদ্র রাজপরিবারের সন্তান ছিলেন। ভিক্ষু হিসেবে দেশ-বিদেশ ঘুরে জ্ঞান অন্বেষণ করেছেন। জ্ঞানের ধন তাঁকে আবিষ্ট করে রেখেছে। পার্থিব ধন তাঁর কাছে তৃণের তুচ্ছ। বিনয়ের সাথে মগধ রাজার প্রস্তাব ফিরিয়ে দিলেন। রাজা তখন বললেন, ‘আমরা যদি গুণের পূজা না করি তাহলে কীভাবে ধর্মের রক্ষা করব। আপনি অনুগ্রহ করে আমার প্রার্থনাকে অগ্রাহ্য করবেন না।’ শেষ পর্যন্ত শীলভদ্র প্রস্তাব গ্রহণ করলেন। প্রাপ্ত রাজস্ব তিনি ব্যক্তিগতভাবে গ্রহণ না করে পুরো অর্থ ব্যয়ে একটি বৌদ্ধবিহার (সংঘারাম) নির্মাণ করে দিলেন, যাতে সেখানে ব্যাপক জ্ঞানচর্চা হতে পারে। সৃষ্টি হতে পারে জ্ঞানদীপ্ত আলোকিত মানুষ।
ধর্মগুরু আচার্য ধর্মপাল বয়সজনিত কারণে ৬৩৫ খ্রিস্টাব্দে স্বেচ্ছায় অব্যাহতি গ্রহণ করলে শীলভদ্র নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান আচার্য বা চ্যান্সেলরের পদ লাভ করেন। শীলভদ্র ২০ বছরের বেশি নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান আচার্যের দায়িত্ব পালন করেন। এমনিতেই নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের খ্যাতি চীন, জাপান, তিব্বত, সিংহল, সুমাত্রা, বার্মা, লাওস, মঙ্গোলিয়া, প্রাচ্য, দূর-প্রাচ্যসহ পৃথিবীর দিক-দিগন্তে ছড়িয়ে ছিল, উপরন্তু শীলভদ্রের অসাধারণ জ্ঞান ও পাণ্ডিত্যের কারণে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় আরও ঈর্ষণীয় মর্যাদায় পৌঁছায়। প্রাচীন ভারতের এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থী, শিক্ষার গুণগতমান, সুশৃঙ্খল প্রশাসনিক ব্যবস্থা, যশ-খ্যাতি, উন্নত অবকাঠামো এবং সামগ্রিক পরিবেশ বিবেচনা করে আধুনিককালের পণ্ডিতগণ নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়কে তত্কালীন বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন শ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদায় অভিহিত করে থাকেন। নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় উপমহাদেশের প্রথম এবং বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন আবাসিক আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদায় খ্যাত হয়ে আছে।
শীলভদ্র নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্যের দায়িত্ব পালনকালে হিউয়েন সাঙ এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। এর আগে তিনি বাংলাদেশ পরিভ্রমণ করেন। সুদূর চীন থেকে আসা এই মহান ছাত্রকে (বৌদ্ধ ভিক্ষু) আচার্য শীলভদ্র অত্যন্ত আগ্রহের সাথে সাদরে শিষ্য হিসেবে গ্রহণ করে নিজ দায়িত্বে অধ্যয়নের ব্যবস্থা করেন। হিউয়েন সাঙ নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঁচ বছরের অধিক অধ্যয়ন করেন। ৬০১ খ্রিস্টাব্দে চীনের বর্তমান হোনান ফু নগরে সম্ভ্রান্ত সুই রাজপরিবারে হিউয়েন সাঙের জন্ম। এশিয়ার উত্তর দিক দিয়ে ৬৩০ খ্রিস্টাব্দে ভারতে প্রবেশ করেন, তখন তাঁর বয়স ত্রিশ। হিউয়েন সাঙ চীনসম্রাটের অনুমতিলাভে ব্যর্থ হয়ে ৬২৯ খ্রিস্টাব্দে কোনো একসময়ে তাঁর দেশ থেকে যাত্রা শুরু করেন। দীর্ঘ ১৫০০ মাইল পথ, পাহাড়, পর্বত, মরুভূমি বিপদসংকুল অরণ্য অতিক্রম করে সম্ভবত খাইবার গিরিপথ দিয়ে ৬৩০ সালে ভারতে প্রবেশ করেন। সিন্ধু নদী পার হয়ে কাশ্মীর, সেখান থেকে মথুরা, কনৌজ, গঙ্গানদী, প্রয়াগ, বারাণসী, এলাহাবাদ, শ্রাবন্তী, বৈশালী, কপিলাবস্তু, সারনাথ, গয়া, পাটলীপুত্র, উজ্জয়নী, কুশানগর, রাজগৃহ মোটকথা বুদ্ধের জীবনের সাথে সংশ্লিষ্ট সকল স্থানই পরিভ্রমণ করেন। তাছাড়া, চম্পা, কর্ণসুবর্ণ ও কলিঙ্গ ভ্রমণ করেন।
হিউয়েন সাঙ ৬৩০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ৬৪৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ভারতবর্ষে অবস্থান করে বহু তীর্থস্থান ও বৌদ্ধবিহার পরিভ্রমণ করেন। বুদ্ধের জন্মস্থানে অবস্থান করে গৌতম বুদ্ধের মহান শিক্ষা ও বাণীকে হ্নদয়ঙ্গম করার প্রবল আকুলতায় তাঁকে বাংলাদেশ তথা ভারতভূমি টেনে আনে। তাঁর এই আকুলতা সৃষ্টি হয় অপর চৈনিক পরিব্রাজক ফা-হিয়েন-এর রচনা পাঠ করে। ফা-হিয়েন ৩৯৯ থেকে ৪১৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ভারতবর্ষে অবস্থান করে জ্ঞান-অন্বেষণ করেন। তিনিও নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিলেন। ভারতের রীতিনীতি, পদ্ধতি, ধর্ম ইত্যাদি সম্পর্কে ‘ফো-কো-কি’ নামক গ্রন্থ-সহ বহু পুস্তকরাজি রচনা করেন। চীন দেশে সর্বপ্রথম খ্রিস্টীয় ৬৭ অব্দে বৌদ্ধধর্ম প্রচার শুরু হয় এবং এর তিন শত বছর পরে ফা হিয়েন ভারতে আসেন।
প্রাচীনকালে ভারতবর্ষ ও চীনের মধ্যে অবাধ জ্ঞানবিনিময় হতো। ‘বেঁচে থাকার জন্য বেঁচে থাকা নয়, জানবার জন্যেই জীবন’—এই ব্রত নিয়ে সেসময়ে চীন থেকে অন্তত একশত জন পরিব্রাজক পৃথক পৃথকভাবে ভারতে শিক্ষাগ্রহণ করতে আসেন। বৌদ্ধধর্ম প্রচারের উদ্দেশে ভারতেরও বহু পণ্ডিত চীন গমন করেন। তাছাড়া, চৈনিকরা সংস্কৃত ভাষা শেখার জন্য ভারতীয় পণ্ডিতদের সমাদর করে চীনে নিয়ে যেতেন। সেসময়ে যেসব চৈনিক পরিব্রাজক বাংলাদেশ তথা ভারতভূমিতে আসেন তাঁদের মধ্যে সর্ববিখ্যাত হিউয়েন সাঙ।
হিউয়েন সাঙ বাংলাদেশের একাধিক স্থানে পরিভ্রমণ করেন। ৬৩৮ খ্রিস্টাব্দে তিনি প্রাচীন বাংলার সমতট রাজ্যের রাজধানী ঐতিহাসিক লালমাই-ময়নামতিতে আসেন। খ্রিস্টীয় ৭ম শতাব্দীতে চন্দ্রবংশীয় রাজা শ্রী ভবদেব কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত এখানকার আনন্দ বিহারে (শালবন বিহার) তিনি অবস্থান করে কিছুদিন শিক্ষালাভ করেন। ধর্ম ও জ্ঞানচর্চার উচ্চপাদপীঠ আন্তর্জাতিক মিলনকেন্দ্র এই মহাবিহার বা বিশ্ববিদ্যালয়ে তখন চার হাজার ভিক্ষু (শিক্ষার্থী) জ্ঞানলাভ করতেন। লালমাই-ময়নামতি ছাড়াও বগুড়ার মহাস্থানগড় (পুণ্ড্রনগর বা পুণ্ড্রবর্ধন), নওগাঁর পাহাড়পুরের সোমপুর মহাবিহার তিনি পরিভ্রমণ করেন।
হিউয়েন সাঙ যখন ছাত্র তখন নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রসংখ্যা ১০ হাজার। বিভাগের সংখ্যা ১০০। ১৫০০ শিক্ষক, ১৫০০ স্টাফ। দৈনিক ১০০ সভামঞ্চ থেকে ১০০ বক্তৃতা দেয়া হতো। অধ্যাপকদের মধ্যে একমাত্র শীলভদ্র একাই ১০০ বিভাগের প্রতিটিতেই গভীর জ্ঞান রাখতেন। চীন, জাপান, তিব্বত, কোরিয়া, জাভা দ্বীপ, মঙ্গোলিয়া, দক্ষিণ এশিয়াসহ বিভিন্ন দেশ থেকে বহু ছাত্র উচ্চশিক্ষার জন্য নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমবেত হতেন। নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ে তখন ভর্তি হওয়া ছিল তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ। ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে উত্তীর্ণ হয়ে শিক্ষার্থীদের ভর্তি হতে হতো। শতকরা বিশ জন ছাত্র ভর্তির সুযোগ পেত। বিশ বছরের কম বয়সের ছাত্রকে ভর্তি করা হতো না।
নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমুদয় ব্যয় নির্বাহের জন্য গুপ্ত রাজাগণ, পরবর্তীকালে পাল রাজাগণ উদার হস্তে অনুদান দিতেন। শিক্ষার্থীদের বাসস্থান ও আহারের খরচসহ শিক্ষার পুরো ব্যয়ভার বহন করত কর্তৃপক্ষ। গুপ্তসম্রাট হর্ষবর্ধন শিলাদিত্য নিজে একজন প্রথিতযশা কবি, নাট্যকার ও শিক্ষানুরাগী হওয়ার কারণে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের পৃষ্ঠপোষকতার প্রতি বিশেষ যত্নবান ছিলেন। হিউয়েন সাঙের বর্ণনা অনুযায়ী, সম্রাট হর্ষবর্ধন রাজস্বের এক-চতুর্থাংশ সাহিত্যসেবীদের জন্য ব্যয় করতেন। নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব বিপুল পরিমাণ কৃষিজমি ও দুধের খামার ছিল। হিউয়েন সাঙের ভাষ্যমতে, আগে নির্দিষ্ট করে দেয়ার কারণে সম্রাট হর্ষবর্ধনের মৃত্যুর (খ্রি. ৬৪৬ মতান্তরে ৬৪৭ খ্রি.) চল্লিশ বছর পরও ২০০টি গ্রাম নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যয় নির্বাহের জন্য নির্দিষ্ট ছিল এবং সেখান থেকে চাল, মাখনসহ বিভিন্ন খাদ্য সরবরাহ করা হতো।
আরকলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ার তত্ত্বাবধানে ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দে নালন্দা মহাবিহার খননের মাধ্যমে উপরি-উক্ত বর্ণনার মূল্যবান প্রত্ননিদর্শন অনাবৃত হয়। তাতে দেখা যায়, নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ক্যাম্পাসের আয়তন ৩০ একর। এই আয়তনের মধ্যে ক্যাম্পাসের বিভিন্ন ভবন ও স্থাপনা বিদ্যমান ছিল। ধ্বংসপ্রাপ্ত ভবনসমূহ অতীত ঐতিহ্য হিসেবে বর্তমানেও বিস্ময়ের সৃষ্টি করে আসছে। ভবনসমূহ পোড়নো ইট দিয়ে তৈরি এবং খুবই মজবুত।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণার গুণগত মান নির্ভর করে লাইব্রেরির মানের ওপর। বিশ্ববিদ্যালয়ের হূদপিণ্ড হচ্ছে লাইব্রেরি। নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ে রত্নসাগর, রত্নবোধি ও রত্নরঞ্জক নামে নয় তলা পর্যন্ত বিশিষ্ট তিনটি বড় বড় লাইব্রেরি ছিল। নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত (অ্যাফিলিয়েটেড) ছিল বহু বিহার বা মহাবিদ্যালয়।
কেবলমাত্র মূল ক্যাস্পাসের ভিতরে আটটি মহাবিদ্যালয়ের কথা উল্লেখ করেছেন হিউয়েন সাঙ। ‘শ্রীনালন্দা-মহাবিহার-আর্য-ভিক্ষু-সঙ্ঘস্য’ নামীয় সীলমোহর থেকে কলেজ বা মহাবিদ্যালয়ের পরিচয় লাভ করা যায়। তাছাড়া প্রধান ক্যাম্পাসের অভ্যন্তরে একটি চারু ও কারুকলা মহাবিদ্যালয় ছিল, যা গুপ্ত সম্রাট কুমারগুপ্ত প্রতিষ্ঠা করেন। আচার্য শীলভদ্র নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়কে এভাবে একটি পরিপূর্ণ আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সফলভাবে পরিণত করতে সক্ষম হন। তিনি জ্ঞানচর্চার উদার স্বাধীনতা, হিন্দু, বৌদ্ধ ধর্মসহ বিভিন্ন ধর্ম ও সম্প্রদায়ের ধর্মশাস্ত্র অধ্যয়ন ধর্মনিরপেক্ষ বিষয়াদির পঠন-পাঠন, অধ্যয়ন-অধ্যাপনা, তর্ক-বিতর্ক পরিচালনা, অনুসন্ধানমূলক গবেষণা ও অনুশীলন নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ে নিশ্চিত করেন। শীলভদ্র কঠোর নিয়ম-শৃঙ্খলার সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালনা করতেন।
শীলভদ্র ছাড়াও পরবর্তীকালে আরও দুইজন বাঙালি পণ্ডিত নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য পদ লাভ করেছিলেন। তাঁরা হলেন, শান্তিরক্ষিত ও চন্দ্রগোমিন। বাংলার আরেক গৌরবদীপ্ত সন্তান শ্রীজ্ঞান অতীশ দীপঙ্করও সমতট রাজ্যের মানুষ। তিনিও দশম শতাব্দীর বিশ্ববিশ্রুত বাঙালি পণ্ডিত। অতীশ দীপঙ্কর প্রথমে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এবং পরে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক পদে নিযুক্ত হন। তিনি ৯৮০ খ্রিস্টাব্দে বর্তমান মুন্সীগঞ্জ জেলার বজ যোগিনী গ্রামে জন্মলাভ করেন, মৃত্যুবরণ করেন ১০৫৩ খ্রিস্টাব্দে। তাছাড়া পদ্মসম্ভব, বুদ্ধকৃতি, স্থিরমালি, কমলশীল, কুমারজীব, পরমার্থ, শুভাকর, ধর্মদেব, নাগার্জুন, অঙ্গ, আর্যদেব, বসুন্ধরা, দিননাগ, শীলরক্ষিত, জীনমিত্র, প্রভামিত্র, চন্দ্রপাল প্রমুখ খ্যাতিমান পণ্ডিত সেখানে অধ্যাপনা করেছেন।
নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় খ্রিস্টীয় পঞ্চম শতাব্দীতে গুপ্ত সম্রাট কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত হয় এবং মুসলিম শাসক মুহম্মদ বিন কাসিম কর্তৃক ১০৩৭ খ্রিস্টাব্দে আক্রমণের শিকার হয়ে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। একটানা এক হাজার বছরের বেশি সময় এই বিশ্ববিদ্যালয় সুনামের সাথে টিকে ছিল।
হিউয়েন সাঙ তাঁর প্রিয় শিক্ষক আচার্য শীলভদ্রের নিকট যোগাচার ও বিজ্ঞানাবাদ শাস্ত্র অধ্যয়ন করেন। তিনি শীলভদ্রকে দেবতার মতো ভক্তি ও মান্য করতেন। হিউয়েন সাঙ বলেছেন, ‘বিভিন্ন দেশের পণ্ডিত ও শিক্ষকের কাছে বৌদ্ধশাস্ত্র ও বৌদ্ধযোগের গ্রন্থ পাঠ করে যেসকল সন্দেহ কিছুতেই দূর হয়নি শীলভদ্রের কাছে দীক্ষা ও উপদেশ নিয়ে সে সকল সন্দেহ দূরীভূত হয়েছে। কাশ্মীরসহ ভারতের শীর্ষ বৌদ্ধ পণ্ডিতরা যেসকল বিষয়ে আমার সংশয় দূর করতে পারেননি, অথচ শীলভদ্র সেগুলো এক কথায় দূর করে দিয়েছেন।’ হিউয়েন সাঙের বর্ণনা : নৈতিক, বুদ্ধিবৃত্তিক ও আত্মিক—এই তিনটি আদর্শ মেনে চলা ছাড়াও বুদ্ধের ন্যায় ছাত্রদের শীলভদ্র দীক্ষা দিয়ে বলতেন, ‘দুঃখের প্রকৃত কারণ হচ্ছে মানুষের আসক্তি বা তৃষ্ণা। এই আসক্তি যতদিন থাকবে ততদিন দুঃখভোগ অনিবার্য; আসক্তির বিনাশ হলে দুঃখ হতে মুক্তি লাভ হবে।’
বুদ্ধ প্রদর্শিত অষ্টাঙ্গিক মার্গ বা অষ্টপথ-এর সাহায্যে ছাত্রদের চরিত্র গঠনে শীলভদ্র বিশেষ যত্নবান থাকতেন। এই অষ্টপথ হলো—সত্ বাক্য, সত্ কার্য, সত্ জীবন বা সত্ জীবিকা, সত্ চেষ্টা, সত্ চিন্তা, সত্ চেতনা, সত্ সংকল্প বা সত্ প্রতিজ্ঞা, সত্ দর্শন বা সম্যক সমাধি। শীলভদ্র বুদ্ধের মহান বাণী দীক্ষা দিয়ে ছাত্রদের শেখাতেন যে, প্রথম তিনটি মার্গ পালন করলে সত্শীল বা শুদ্ধশীল হওয়া যাবে। শীল বলতে নৈতিক শুদ্ধতা বোঝায়। দ্বিতীয় তিনটি মার্গ পালন করলে সমাধি অর্থাত্ চিত্তের প্রশান্তি আসবে। শেষের দু’টি মার্গ পালন করলে উদিত হবে প্রজ্ঞা অর্থাত্ পরমজ্ঞান। শীলভদ্র ছাত্রদের সত্যপথ জানতে শেখাতেন এবং বিনম্র ব্যবহার দ্বারা তাঁদের প্রাত্যহিক জীবন নিয়ন্ত্রণ করতেন। সাম্য-মৈত্রী-ভ্রার্তৃত্ব, মানবতাবোধ, পরমতসহিষ্ণুতা সর্বোপরি বৌদ্ধধর্মীয় ও সর্বজনীন শিক্ষায় শিক্ষার্থীদের শিক্ষিত করতেন।
শীলভদ্র ছিলেন অসাম্প্রদায়িক চেতনার মানুষ। নিজধর্মের প্রতি ছিলেন গভীর অনুরাগী। কিন্তু সকল ধর্ম ও ধর্মমতের প্রতি ছিলেন অতিশয় শ্রদ্ধাশীল। অতিমাত্রায় পরমতসহিষ্ণু ও অত্যন্ত মানবিক গুণের অধিকারী। মানুষ মানুষের প্রাণ রক্ষা করবে, একে অপরের সহায়ক হবে, মহান স্রষ্টার সকল সৃষ্টিকে মমত্ব দিয়ে ভালোবাসতে হবে—এই মানবিক কর্তব্যর প্রতি শীলভদ্র ছিলেন সদাশয়। হিউয়েন সাঙ-এর বর্ণনামতে, শীলভদ্র মহাযান বৌদ্ধ ছিলেন। বৌদ্ধধর্মের অন্তর্গত আঠারটি সম্পদায়ের ধর্মশাস্ত্র তাঁর রপ্ত ছিল। তাঁর মনের উদারতা ছিল বিশাল। বৌদ্ধধর্ম গ্রহণের পর তাঁকে দণ্ডদেব নামে ভূষিত করা হয়। তিনি ব্রাহ্মণদের সমস্ত ধর্মশাস্ত্রও আয়ত্ত করেছিলেন। এমনকি পাণিনির ব্যাকরণ নামক গ্রন্থও। হিউয়েন সাঙ ও হুই লি’র লিখিত বিবরণীতে আরও জানা যায়, আচার্য পণ্ডিত শীলভদ্র ছিলেন সর্বশাস্ত্রে বিশারদ; ভাষা ছিল অত্যন্ত সরল। ধর্মানুরাগ, পাণ্ডিত্যে, প্রশাসনিক দক্ষতা ও কর্তব্যনিষ্ঠায় শীলভদ্র সকলকে অতিক্রম করতে সক্ষম হয়েছেন। জ্ঞানের সকল শাখায় শীলভদ্রের অবাধ বিচরণ ছিল। বৌদ্ধগণের আঠারটি সম্প্রদায় বা বিভাগের বিভিন্ন ধর্মশাস্ত্র ছাড়াও বেদ, হেতুবিদ্যা বা ন্যায়শাস্ত্র, শব্দবিদ্যা বা ব্যাকরণ, শিল্পবিদ্যা, বসায়ন শাস্ত্র, ধাতুবিদ্যা, চিকিত্সাবিদ্যা, সাংখ্য, অথর্ববেদ, বিজ্ঞান ইত্যাদি শাস্ত্রে শীলভদ্র পারদর্শী ছিলেন। প্রতিদিন একশত বেদী হতে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসব বিষয়ে শিক্ষাদান হতো। শীলভদ্র প্রতিদিন অধিকাংশ বেদীতে এসব বিষয়ে পাঠ দিতেন। তিনি নিজে মহাযান মতাবলম্বী হলেও বৌদ্ধধর্মের সকল শাখাশাস্ত্রে বিশেষজ্ঞ ছিলেন। হিন্দু ধর্মের সকল শাস্ত্রেও তাঁর গভীর পাণ্ডিত্য ছিল। আদি ধর্মগ্রন্থ ‘বেদ’ হিউয়েন সাঙ-এর পাঠক্রমে অন্তর্ভুক্ত করেন। সম্ভবত হিউয়েনকে পরধর্মসহিষ্ণুতার মহান আদর্শে গড়ে তোলার জন্যই বেদ পাঠ্যভুক্ত করেন। সাম্য-মৈত্রী-ভ্রাতৃত্ব, মানবতাবোধ, পরমতসহিষ্ণুতা সর্বোপরি বৌদ্ধধর্মীয় ও সর্বজনীন শিক্ষায় হিউয়েন সাঙসহ এখানকার শিক্ষার্থীদের শীলভদ্র গড়ে তোলেন। প্রবল মূল্যেবোধসম্পন্ন নীতি আদর্শেও পূজারী এই শিক্ষার্থীরা জ্ঞানসাধনা দিয়ে চিত্তের বিকাশ ঘটিয়েছেন। পরিশুদ্ধ করেছেন নিজের জীবনকে। সমাজকে উন্নতির ও প্রগতির ধারায় আলোর পথে এগিয়ে নিয়ে গেছেন।
শীলভদ্রের ন্যায়পরায়ণতা ও মহত্ত্ব এত বেশি উঁচুতে ছিল যে, গভীরপ্রজ্ঞা, পরিশীলিত শীলবান জীবন ও গুণাবলির জন্য মহাবিহারে কেউ-ই তাঁকে পরমশ্রদ্ধাবশত নাম উচ্চারণ না করে তাঁকে ‘স্ব-ধর্মনিধি’ (ট্রেজারি অব দি গুড ল) বলে অভিহিত করতেন। সকলে শীলভদ্রকে পিতামহের ন্যায় মান্য করতেন। শীলভদ্রের প্রকৃত নাম অদ্যাবধি জানা যায়নি। প্রাচীন গ্রন্থসমূহে শীলভদ্রের বাল্য নাম ‘দন্তদেব’, ‘দণ্ডদেব’, ‘দন্তসেন’ বলে উল্লেখ আছে। তবে, পিতা-মাতার প্রদত্ত নাম উল্লেখ নেই। জাপানি ভাষায় শীলভদ্রের নামের অনুবাদ হচ্ছে, ‘কাইকেন’, চীনা ভাষায় ‘চিয়েহ হসিয়েন’, তিব্বতি ভাষায় ‘নান-ত্সুল-বজান-পো’। কিছু চীনা লেখায় ‘শি-লো-পো-তো-লো’ বা ‘কি আই-হিয়েন’ বা ‘শীলসম্পন্ন স্থবির’—এই নামটিও ব্যবহূত হয়েছে। বৌদ্ধ অভিধানে ‘শীল’ অর্থ হচ্ছে—ন্যায়পরায়ণতা, সততা, ধার্মিকতা, সদাচরণের বিধি-বিধান মান, কর্তব্যপরায়ণতা, নীতিবান, সুনীতি, নৈতিক শুদ্ধতা ইত্যাদি এবং ‘ভদ্র’ হচ্ছে সমতট রাজবংশীয় উপাধি। বর্ণাঢ্য ব্যক্তিখ্যাতি ও গুণের কারণে মাতা-পিতার রাখা নামে নালন্দায় তাঁকে ডাকার কেউ প্রয়োজনবোধ করেননি। ‘শীলভদ্র’-এর মহত্ত্বের কাছে হারিয়ে গেছে তাঁর প্রকৃত নামও।
নৈতিক, বুদ্ধিভিত্তিক ও আত্মিক-এই তিনটি আদর্শ মেনে চলা ছাড়াও বুদ্ধের ন্যায় ছাত্রদের দীক্ষা দিয়ে শীলভদ্র বলতেন, ‘দুঃখের প্রকৃত কারণ হচ্ছে মানুষের আসক্তি বা তৃষ্ণা। এই আসক্তি যতদিন থাকবে ততদিন দুঃখভোগ অনিবার্য; আসক্তির বিনাশ হলে দুঃখ হতে মুক্তি লাভ হবে।’ বুদ্ধ প্রদর্শিত অষ্টাঙ্গিক মার্গ বা অষ্টপথ-এর সাহায্যে ছাত্রদের চরিত্র গঠনে শীলভদ্র বিশেষ যত্নবান থাকতেন। এই অষ্টপথ হলো—সত্বাক্য, সত্কার্য, সত্জীবন বা সত্জীবিকা, সেচষ্টা, সিচন্তা, সেচতনা, সত্সংকল্প বা সত্প্রতিজ্ঞা, সত্দর্শন বা সম্যক সমাধি। শীলভদ্র বুদ্ধের মহান বাণী দীক্ষা দিয়ে ছাত্রদের শেখাতেন যে, প্রথম তিনটি মার্গ পালন করলে সত্শীল বা শুদ্ধশীল হওয়া যাবে। শীল বলতে নৈতিক শুদ্ধতা বোঝায়। দ্বিতীয় তিনটি মার্গ পালন করলে সমাধি অর্থাত্ চিত্তের প্রশান্তি আসবে। শেষের দু’টি মার্গ পালন করলে উদিত হবে প্রজ্ঞা অর্থাত্ পরমজ্ঞান। শীলভদ্র ছাত্রদের সত্যপথ জানতে শেখাতেন এবং বিনম্র ব্যবহার দ্বারা তাঁদের প্রাত্যহিক জীবন নিয়ন্ত্রণ করতেন।
বাঙালির গৌরব শীলভদ্র আমৃত্যু অকৃতদার থেকেই জ্ঞান অন্বেষণ করেছেন এবং অকাতরে এই জ্ঞান বিতরণ করে গেছেন। নালন্দায় শীলভদ্রের সঙ্গে তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র বুদ্ধভদ্র থাকতেন। তিনিও বিখ্যাত পণ্ডিত ছিলেন। হিউয়েন সাঙ বর্ণনা করেছেন, শীলভদ্রের বয়স যখন ১০৬ তখন তাঁর ভাতিজার বয়স ৭০।
শীলভদ্রের সঙ্গে একান্ত কিছু স্মৃতির কথা হিউয়েন সাঙ বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন। মহান ছাত্র হিউয়েন সাঙের পাণ্ডিত্য দেখে নালন্দার পণ্ডিতেরা সিদ্ধান্ত নিলেন তাঁকে নিজদেশে ফিরে যেতে দেবেন না। কিন্তু শীলভদ্রের উদারচিত্ত এই সিদ্ধান্তে একমত হতে পারেননি। তিনি বলেন, চীন একটি মহাদেশ, বিশাল ব্যাপ্তি এদেশের। হিউয়েন সাঙ চীন দেশে গিয়ে বৌদ্ধধর্ম প্রচার করবেন। তাঁর দ্বারা সত্ধর্মের উন্নতি হবে। তাঁর আদর্শে আলোকিত হবে মানুষ; সিক্ত হবে চৈনিকসমাজ। উপকৃত হবে বিশ্ব-মানবসমাজও। অবশেষে শীলভদ্রের সম্মতিতে ৬৪৫ খ্রিস্টাব্দে নিজ দেশে প্রত্যাবর্তন করেন। ফিরে যাওয়ার সময় বুদ্ধের দেহের পঞ্চাশটি, মতান্তরে একশত পঞ্চাশটি অংশ বা নিদর্শন ও বহু বৌদ্ধমূর্তিসহ প্রায় ৭০০টি বৌদ্ধগ্রন্থের বৌদ্ধপুঁথির পাণ্ডুলিপির বিশাল সম্ভার কুড়িটি ঘোড়ায় বহন করে নিয়ে যান। পাণ্ডুলিপির অনুবাদ ও গ্রন্থ রচনা করে অবশিষ্ট জীবন তিনি অতিবাহিত করেন। মোট ৭৪টি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন বলে ইতিহাসকারদের বিবরণীতে জানা যায়। ভারত ও বাংলাদেশে অন্তত ১৫ বছর কাটিয়ে যাওয়া মহান পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙ তত্সময়ের চীনের সর্বশ্রেষ্ঠ পণ্ডিতের মর্যাদায় অভিষিক্ত হন। হিউয়েন সাঙ ৬৬৪ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন।
হিউয়েন সাঙ-এর বিবরণী ও পৌরাণিক ইতিহাস থেকে জানা যায়, শীলভদ্র একজন সুলেখক ও প্রথিতযশা গ্রন্থকার ছিলেন। নালন্দাতে জ্ঞানের অধীত সকল বিভাগ ও শাস্ত্রেই তিনি পুস্তক (পাঠ্য ও রেফারেন্স) রচনা করেছিলেন। হিউয়েন সাঙ লিখেছেন, শীলভদ্র একাই ১০০ বিভাগের প্রতিটি বিষয়ের ওপর গভীর জ্ঞান রাখতেন। সে কারণে পণ্ডিতদের ধারণা তিনি হয়তো কয়েক শত বই লিখেছিলেন। তবে তাঁর লেখা ও মূল পুস্তকরাজির কোনো সংগ্রহই নেই। পণ্ডিতদের অভিমত, নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংসের সময় সম্ভবত অন্য গ্রন্থাবলীর সঙ্গে শীলভদ্রের পুস্তকগুলোও ধ্বংস হয়ে যায়। তিব্বতীয় ভাষায় শীলভদ্রের রচিত বৌদ্ধধর্ম ও দর্শনের ওপর একমাত্র গ্রন্থ ‘আর্য বুদ্ধ ভূমি ব্যাখান’ বর্তমান আছে। এটিতে পাঠ রয়েছে ১৩১ পৃষ্ঠা আর তিব্বতি ভাষায় নির্ঘণ্ট রয়েছে ১১৫ পৃষ্ঠার। প্রাচীন সংস্করণ হিসেবে তিব্বতে বর্তমানেও ব্যাপকভাবে সমাদৃত বিখ্যাত এই গ্রন্থটি। বইটির জাপানি অনুবাদ প্রথম প্রকাশ পায় ১৯৪০ সালে, পুনর্মুদ্রিত হয় ১৯৮২ সালে এবং তিব্বতি পাঠের পুনর্মুদ্রণও জাপানে হয়েছে। জাপানি ভাষায় পুরো বইটি ৩০৩ পৃষ্ঠার। তিব্বতীয় অনুবাদের তালিকাটি প্রথমে ফার্সিতে পরে ইংরেজিতে অনূদিত না হলে শীলভদ্রের রচিত একমাত্র টিকে যাওয়া গ্রন্থেরও সন্ধান পাওয়া যেত না।
বাঙালি জাতির মহামনীষা শিক্ষাগুরু শীলভদ্র ৬৫৪ খ্রিস্টাব্দে ১২৫ বছর বয়সে পরলোকগমন করেন। শীলভদ্রের মৃত্যুসংবাদটিও হিউয়েন সাঙের লেখনী থেকে জানা যায়। হিউয়েন সাঙ ভারতীয় পণ্ডিত প্রজ্ঞাদেবকে প্রেরিত এক পত্রে বলেন, ‘কিছুদিন আগে ভারত থেকে এসেছেন—এমন একজন দূতের কাছ থেকে জানতে পারলাম পণ্ডিত শীলভদ্র আর নেই। এই সংবাদে আমার হূদয় বেদনায় এত জর্জরিত হয়েছে যে, যার কোনো সীমা নেই…।’
প্রাচীন বাংলার মহান শিক্ষক পণ্ডিত শীলভদ্রের প্রতি পরম শ্রদ্ধা নিবেদন করে পরিশেষে এই অভিমত রাখছি যে, বাঙালি জাতির ইতিহাস অতি প্রাচীন; হাজার হাজার বছরের। ইতিহাসমতে, মানবজাতির সৃষ্টির সূচনা থেকেই বঙ্গদেশে মানুষের বাস শুরু হয়। লক্ষ-কোটি বছর আগের বাংলাদেশ কেমন ছিল তা জানা যাচ্ছে না। তবে, বাঙালি জাতির বা বাংলাদেশের পাঁচ হাজার বছরের লিখিত ইতিহাস পাওয়া যায়। আমাদের প্রিয় বাংলাদেশের প্রাচীন নাম ‘বঙ্গদেশ’। অতি পুরনো এই দেশ। প্রাচীনকালে এ দেশের মানুষদের বঙ্গাল, বাঙ্গাল, বঙ্গবাসী ইত্যাদি নামে ডাকা হতো। বঙ্গের সন্তানরাই আজকের বাঙালি জাতি। বঙ্গদেশ কালক্রমে বাংলাদেশ হয়েছে। এই বঙ্গই আমাদের ধাত্রী। বঙ্গমাতা তাঁর স্বর্ণজঠরে আধুনিককালে যেমনি ধারণ করেছে বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মতো সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বঙ্গসন্তানকে; যাঁর সংগ্রামী নেতৃত্বে প্রাচীন বঙ্গদেশের বুকে মহান একাত্তরের ষোল ডিসেম্বরে রক্তাক্ত অভ্যুদয় ঘটে ‘বাংলাদেশ’ নামক স্বাধীন সার্বভৌম একটি জাতিরাষ্ট্রের, তেমনি প্রাচীনকালে ধারণ করেছে আচার্য মহাস্থবির শীলভদ্রের মতো পণ্ডিতকে; যিনি বাঙালি জাতির আদি গৌবরস্তম্ভ। ‘শীলভদ্র’, ‘হিউয়েন সাঙ’ এবং ‘নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়’ বাংলা ও বাঙালির সভ্যতা-সংস্কৃতির ইতিহাসে খ্যাতিমান। এই খ্যাতি আমাদের গৌরবের; এই খ্যাতি আমাদের অহংকারের। হিউয়েন সাঙ বিদেশি হলেও তিনি বাংলা তথা ভারতীয় সভ্যতার সাথে নিবিড় সখ্য গড়ে তুলেছিলেন। তাঁর লেখায় উঠে এসেছে অতীত বঙ্গদেশ বা বাংলার শিক্ষা, ধর্ম, সংস্কৃতি, আর্থ-সামাজিক অবস্থা। পণ্ডিত শীলভদ্রের সাথে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন মহান পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙ। তাঁর লেখায় চিরায়ত বাংলার প্রতিচ্ছবি বিশেষভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। হিউয়েন সাঙয়ের বর্ণনা সাক্ষ্য দেয় সমৃদ্ধ এক প্রাচীন বাংলাদেশের; আমাদের অংশীদার করে গৌরবময় বাঙালি সভ্যতার; ভাবতে শেখায় মহান শিক্ষক পণ্ডিত শীলভদ্র বাঙালির চির অহংকার, সদা-সগৌরব।
তথ্যসূত্র :ইন্টারনেট।

Leave a Reply