Deprecated: Function WP_Dependencies->add_data() was called with an argument that is deprecated since version 6.9.0! IE conditional comments are ignored by all supported browsers. in /home/amadersa/public_html/wp-includes/functions.php on line 6131
গাজী মাজহারুল আনোয়ারের কিছু কালজয়ী গানের গল্প

গাজী মাজহারুল আনোয়ার এর জীবনী। কিছু কালজয়ী গানের গল্প

গাজী মাজহারুল আনোয়ার। গীতিকার, চিত্র পরিচালক ও প্রযোজক। মুক্তিযুদ্ধের সময়কার সেই বিখ্যাত গান ‘জয় বাংলা বাংলার জয়’-এর গীতিকার তিনি। এ ছাড়া অসংখ্য দেশাত্মবোধক গান লিখেছেন তিনি। তাঁর লেখা গানের সংখ্যা ২০ হাজারের বেশি, পৃথিবীতে যা বিরল। আজ সকালে তিনি চলে গেছেন না ফেরার দেশে।কিংবন্তিতুল্য এই গীতিকার গান নিয়ে নিজের কথা বলেছিলেন মাসুম অপুকে। ২০০৪ সালের ৮ জুলাই প্রথম আলোতে ছাপা হয়েছিল। গাজী মাজহারুল আনোয়ারের স্মরণে লেখাটি আবার প্রকাশ করা হলো।

যে দিনগুলোতে বাংলাদেশের মানুষজন পছন্দের গান শোনার জন্য বেতারে কান রাখতেন, যখন দেশে টেলিভিশন চ্যানেল ছিল মাত্র একটি সেসময় দিনে অনেকবার শোনা যেত গাজী মাজহারুল আনোয়ার রচিত গান।

 

আজ রোববার সকালে মৃত্যু হয়েছে বাংলাদেশের অনেক কালজয়ী দেশাত্মবোধক গানের রচয়িতা গাজী মাজহারুল আনোয়ারের।

বোকো হারাম: আফ্রিকার নিষ্ঠুরতম সন্ত্রাসী সংগঠনের উত্থানপর্ব

তাঁর পরিবারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে বেশ কিছুদিন ধরেই অসুস্থ ছিলেন তিনি। সকালে অসুস্থ বোধ করলে তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তিনি শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। গাজী মাজহারুল আনোয়ারের বয়স হয়েছিল ৭৯ বছর।

 

তিনি একই সাথে চলচ্চিত্র পরিচালক, প্রযোজক, জনপ্রিয় অনেক চলচ্চিত্রের গানের গীতিকার। গাজী মাজহারুল আনোয়ার রাজনীতিতেও সম্পৃক্ত ছিলেন।

কিন্তু পাঁচ দশকের মতো সময় তিনি দোর্দণ্ড প্রতাপে বাংলাদেশের সঙ্গীতের জগতে বিচরণ করেছেন।

 

মুক্তিযুদ্ধের বিশেষ যে দিনগুলো বছরের নানা সময় উদযাপন করা হয় সেসময় সারা দেশজুড়ে বাজানো হয় তারই লেখা, ‘জয় বাংলা বাংলার জয়’।

 

‘আকাশের হাতে আছে একরাশ নীল’,’গানেরই খাতায় স্বরলিপি লিখে’, ‘একতারা তুই দেশের কথা বল রে এবার বল’, ‘আমার মন বলে তুমি আসবে’, ‘এক নদী রক্ত পেরিয়ে’, ‘সাগরের তীর থেকে’, ‘এই মন তোমাকে দিলাম’, ‘আমি রজনীগন্ধা ফুলের মতো’ – এরকম অসংখ্য হৃদয়ে দোলা লাগানো কালজয়ী গানের গীতিকার তিনি।

 

দুই হাজার ছয় সালে বিবিসি বাংলার শ্রোতাদের মনোনীত সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাংলা গানের তালিকায় ছিল তার রচিত ‘জয় বাংলা বাংলার জয়’, ‘একবার যেতে দে না আমার ছোট্ট সোনার গাঁয়ে’, ‘একতারা তুই দেশের কথা বল’ এই তিনটি গান।

 

যেভাবে গান লেখায় হাতেখড়ি

ষাটের দশকের শুরুতে তিনি চিকিৎসায় পড়াশুনা শুরু করেন। দুই হাজার তের সালে বিবিসি বাংলার সাথে এক কথোপকথনে তিনি বলেছিলেন, জন্মস্থান কুমিল্লায় স্কুলে পড়ার সময় থেকেই তিনি দেয়াল পত্রিকায় কবিতা লিখতেন।

 

কবিতা লেখা কিভাবে তাকে গানের রচয়িতা করে তুলল সেটি বর্ণনা করে তিনি বলছিলেন, “ইন্টারমিডিয়েট পাশ করার পর যখন মেডিকেল কলেজে এসে ভর্তি হলাম, সেখানে একটা নাটক হওয়ার কথা। সেটাতে একটা গানের প্রয়োজন হয়েছিল। গানটা সেসময়কার প্রখ্যাত আবু হেনা মোস্তফা কামাল সাহেবের লেখার কথা ছিল। কিন্তু তিনি সময় স্বল্পতার কারণে গানটা লিখতে পারেননি। তো আমি সেই সময় নাটকের পরিচালককে বললাম আপনি ইচ্ছা করলে আমাকে একটু ট্রাই করে দেখতে পারেন। তারপর আমি একটি গান লিখে ফেললাম।”

 

গাজী মাজহারুল আনোয়ারের সাথে গানগল্প

বিবিসি বাংলার শ্রোতাদের মনোনীত সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাংলা গান

সময়ের তাগিদেই গান লেখা শুরু করেছিলাম। সময়টা ছিল সংগ্রামের। অধিকার আদায়ে কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র—যে যার মতো আন্দোলন করছেন। অনুভব করলাম আন্দোলনে নামার তাগিদ। কলমটাকে মাধ্যম করে জড়িয়ে গেলাম আন্দোলনে। মুক্তিযুদ্ধের আগে বেশ কিছু ছবির প্রযোজনা করেছিলাম। সে সুবাদে চলচ্চিত্রের সঙ্গে সরাসরি মিশে ছিলাম। ছবির জন্যই লিখেছিলাম, ‘জয় বাংলা বাংলার জয়/ কোটি প্রাণ একসাথে জেগেছে অন্ধ রাতে…’ আনোয়ার পারভেজ সুর করেছিল এ গানের। অবশ্য ছবির গান বললে কিছুটা ভুল হবে। কারণ, এ গানের জন্যই ‘জয় বাংলা’ ছবির কাজ শুরু হয়েছিল। প্রথম দিকেই এই গান মুক্তিযুদ্ধের থিম সংয়ে পরিণত হয়। স্বাধীন বাংলা বেতারের অধিবেশন শুরু হতো এ গানের মাধ্যমে, শেষও হতো এটা বাজিয়ে। সারা দিনই প্রায় বাজত। চারদিকে যুদ্ধ। পালিয়ে বেড়াচ্ছিলাম। চট্টগ্রাম, সীতাকুণ্ড, কুমিল্লা। এর মধ্যেই প্রতিদিন তৈরি হতো গান। সময়টাই যেন ছিল গান লেখার প্রেরণা। কলমকে অস্ত্র বানিয়েই যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলাম আমি।

এর মধ্যে লিখলাম ‘হে বন্ধু বঙ্গবন্ধু’, ‘একতারা তুই দেশের কথা বলরে এবার বল’, ‘যদি আমাকে জানতে সাধ হয়’সহ বেশকিছু গান। সত্য সাহার সুরে ‘যদি আমাকে জানতে সাধ হয়’ এবং খন্দকার নুরুল আলমের সুরে ‘একতারা তুই দেশের কথা’ গানগুলো সে সময়ই অসম্ভব জনপ্রিয় ছিল। কিছু গান আমি গদ্যাকারে লিখেছিলাম, গানে গানে ফুটে উঠেছিল সেই সময়ের খণ্ডচিত্র। যেমন ‘বউ যায়গো পালকি চড়ে…দুরুম দুরুম গ্রেনেড ফুটছে, কাঁপছে তার বুক, মুক্তির নেশায় তবুও সে উন্মুখ।’ বলা যায়, গানগুলো যেন একেকটা মিউজিক ভিডিও। আরও আছে এমন—‘বাছারে বাছা তুই আরেকটা দিন বাড়িতে থেকে যা, উড়কি ধানের মুড়ি এখনো হয়নি শেষ, এমনই করে রাখত ধরে আমার মা’ গানগুলো কাল্পনিক নয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় যা দেখেছি, তা-ই লিখেছি। ৭১ সালের পর আমাদের চলচ্চিত্রে বারবার ফিরে এসেছে মুক্তিযুদ্ধ। আমার গানেও এর প্রভাব পড়েছিল। ‘আমায় একটি ক্ষুদিরাম দাও বলে কাঁদিস নে মা…’ ‘ওরা ১১ জন’ ছবির জন্য লেখা আমার তেমনই একটি গান।

নিউইয়র্ক টাইমসে প্রবন্ধ লিখে সেরা হলেন বাংলাদেশি শিক্ষার্থী আরিয়া হক

সময়টা ছিল খুব অস্থির। সবকিছুতেই পরিবর্তনের হাওয়া। গ্রাম ছেড়ে মানুষ শহরে চলে আসছিল। যান্ত্রিকতা এসে যাচ্ছিল সবকিছুতে। জীবনের তাগিদে আমিও ছিলাম শহরে। গ্রামের জন্য মনটা কাঁদত।

ওই সময় আমার আবেগ ফুটে উঠেছে আমার লেখা গানে—‘একবার যেতে দে না আমার ছোট্ট সোনারগাঁয়ে’, ‘আমায় যদি প্রশ্ন করো’ ইত্যাদি গান সেই সময়ে লেখা। চলচ্চিত্রে আমার গান লেখা শুরু হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের আগেই।

এক বিকেলে সত্য সাহা বললেন ছবির জন্য গান লিখতে। সে রাতেই লিখেছিলাম, ‘আকাশের হাতে আছে একরাশ নীল…’ পরদিন সত্যদার কাছে নিয়ে গেলে তিনি দেখে বললেন, ‘তোরে দিয়া হইব।’ চলচ্চিত্রে প্রথম গান লিখেছিলাম ‘আয়না ও অবশিষ্ট’ ছবির জন্য। ওই সময় থেকে ধারাবাহিকভাবে লেখা। তবে আমি কখনো একটা নির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্যে থাকিনি। বলা চলে, আমি গান নিয়ে গবেষণা করেছি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আমার গানের বিবর্তন ঘটেছে। বিভিন্ন ধারায় আমি লিখেছি। আমার গানে আধ্যাত্মিক প্রভাব এসেছে। ‘আছেন আমার মুক্তার, আছেন আমার বারিস্টার’ কিংবা রথীন্দ্রনাথ রায়ের গাওয়া ‘সবাই বলে বয়স বাড়ে, আমি বলি কমে’ গানগুলো আমার নিজেরই বিশেষ পছন্দের। বাউলগানের প্রভাবে লিখেছিলাম, ‘আউল বাউল লালনের দেশে মাইকেল জ্যাকসন আইলোরে…’। বৈষ্ণব, কীর্তন, সর্বোপরি রাধা–কৃষ্ণের প্রভাবে লিখেছি, ‘সাধকে মনমোহন হরি গোপীজন, মন চায় বাসরী’। তবে কঠিন শব্দ বসিয়ে গান লেখার পক্ষে আমি নই। গান হতে হবে সর্বজনীন। যারা শুনবে, তারা সহজেই যাতে বুঝতে পারে। আমার লেখা ২০ হাজারের অধিক গানের বেশির ভাগই এ পর্যায়ে পড়ে।

গান লেখার পাশাপাশি ছবি পরিচালনা এবং প্রযোজনার কাজও করেছি দীর্ঘদিন। প্রথমে অবশ্য প্রযোজনার দায়িত্বেই ছিলাম। ১৯৬৯ সালে ‘সমাধান’ ছবির মাধ্যমে এ যাত্রা শুরু হয়। প্রায় ৩৩টি ছবি আমার প্রযোজনায় হয়েছিল। আর পরিচালনার কাজটুকু আমি আরও গুরুত্বের সঙ্গেই করেছিলাম। ‘সন্ধি’, ‘স্বাক্ষর’, ‘স্বাধীন’, ‘ক্ষুধা’, ‘সমাধি’, ‘স্বীকৃতি’, ‘পরাধীন’ ইত্যাদি ছবি আমি পরিচালনা করেছিলাম। আমার পরিচালিত সর্বশেষ ছবি ‘আর্তনাদ’। এখন কাজ কমিয়ে দিয়েছি। এ মুহূর্তে পরিবেশ নেই বলেই আমার ধারণা। আমি আশাবাদী। আবার সুস্থ ছবির দিন আসবে। সেদিন হয়তো বেশি দূরে নয়। তবে গান লেখাটাই আমার প্রথম লক্ষ্য। স্বীকৃতিও পেয়েছি গান লিখে। সবচেয়ে বেশি পেয়েছি মানুষের ভালোবাসা।

স্বাধীনতার পর গীতিকার হিসেবে প্রথম রাষ্ট্রপতি স্বর্ণপদক লাভ করি। ২০০২ সালে একুশে পদকসহ বেশ কয়েকবার জাতীয় পুরস্কার পাই। আজকাল আমাদের সংগীতেও নেমেছে একধরনের অস্থিরতা। রিমিক্স গান নিয়ে চলছে নানা কর্মকাণ্ড। কষ্ট লাগে নিজের লেখা গানগুলো যখন ভুল উচ্চারণে, ভুল শব্দে গাওয়া হচ্ছে। রিমিক্সে আমার আপত্তি নেই। কিন্তু যারা রিমিক্স করছে, তাদের ন্যূনতম সৌজন্যবোধ থাকা উচিত। অন্তত গীতিকার, সুরকারকে জানিয়ে, অনুমতি নিয়ে গান কাভার করা উচিত। আমার মতে, সব শিল্পীই জাতীয় সম্পদ। কোনো শিল্পী কোনো দলের নয়, হওয়া উচিতও নয়। সরকার কখনো শিল্পী তৈরি করতে পারে না, কেউ পাঁচ বছরে শিল্পী হয়ে ওঠে না। অনেক বছর সাধনা করে শিল্পী হিসেবে গড়ে ওঠে।

Leave a Reply