চাণক্য নীতি কি মেয়েদের ক্রীতদাসী হিসেবে দেখেছিল? Chanakya Biography, চাণক্য নীতি বাংলায় মহাপন্ডিত চাণক্যের জীবনী

প্রাচীন ভারতে নারীর স্থান বিষয়ে প্রসঙ্গ উঠলে খানিকটা ধন্ধে পড়ে যেতে হয়। স্কুল জীবনে ভারতের ইতিহাস পড়তে গিয়ে জানতে হয়েছিল, প্রাচীন কালে এদেশে নারীর স্থান ছিল খুবই উচ্চে। গার্গী, লোপামুদ্রা, অপালা, বিশ্ববারা প্রমুখ বিদূষীর উদাহরণ তুলে সেই কথা প্রমাণ করেও দেন বই-লেখকরা।

কিন্তু ইতিহাসের ছাত্ররা অনার্স স্তরে গিয়েই জানতে পারেন, সেকালে মোটেই নারীরা সম্মানজনক কোনও অবস্থানে ছিলেন না। কয়েকজন বিদূষীর অবস্থান দেখিয়ে সমাজের সামগ্রিক অবস্থাটা বোঝা কখনওই সম্ভব নয়। সুকুমারী ভট্টাচার্যের গবেষণা পরতে পরতে উন্মোচন করে প্রাচীন ভারতে নারীর ক্রমাগত অবদমনের ইতিবৃত্তকে, তুলে ধরে নারীর আস্টেস্পৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকা শৃঙ্খলকে। প্রাচীন ভারতে নারীর এই অবনমন ও অবদমনকে সবথেকে বেশি মাত্রায় তুলে ধরে ‘চাণক্য নীতি’-র মতো জনপ্রিয় টেক্সট। এই নীতিমালা কৌটিল্য বিষ্ণুগুপ্ত চাণক্য বিরচিত হোক বা না-হোক, এই টেক্সট যে আবহমান ভারতীয় মননের এক জটিল প্রতিচ্ছবি, সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। ‘চাণক্য নীতি’-তে মেয়েদের সম্পর্কে যা বলা হয়েছে, তা আজকের দিনে পড়তে বসলে মাথা খারপ হতে বাধ্য।

‘চাণক্য নীতি’ অনুসারে—

  • আগুন, জল, নারী, বোকা লোক, সাপ এবং রাজপরিবারকে এড়িয়ে চলাই ভাল। (মুশকিল এখানেই। এই তালিকায় ‘নারী’ অন্তর্ভুক্ত হল কীভাবে?)
  • ব্যক্তিগত স্বার্থে অর্থ এবং নারী— দুই বিষয়কেই পরিহার বা পরিত্যাগ করা যেতে পারে। (টাকা আর নারী, চাণক্যের দৃষ্টিতে দুই-ই সমান।)
  • এই নীতির একটি শ্লোকে বলা হয়েছে, যে নারী তাঁর স্বামীর অনুমতি ছাড়াই উপবাস করেন, তিনি তাঁরা স্বামীর আয়ুকে ধ্বংস করেন। (স্বামীর সাপেক্ষ অস্তিত্ব হিসাবেই নারীর অবস্থান।)
  • চাণক্য নীতি জানাচ্ছে— পিতল পরিষ্কার করে ছাই, তামাকে পরিষ্কার করে তেঁতুল, নারীকে পরিষ্কার করে ঋতুস্রাব, নদীর জলকে পরিষ্কার করে তার গতি।(মোটেই মেয়েদের পক্ষে সম্মানজনক নয় এমন ‘সেক্সিস্ট’ উক্তি।)
  • আরও বলা হচ্ছে, ব্যবহার না করলে জ্ঞান নষ্ট হয়, অজ্ঞানতায় পুরুষ নষ্ট হয়, সেনাপতির অভাবে বাহিনী নষ্ট হয় এবং স্বামীর অভাবে নারী নষ্ট হয়। (আবার মেয়েদের স্বাধীন সত্তাকে অস্বীকার।)
  • নারীর পরামর্শ গ্রহণ না করতে, নারীর সংস্পর্শ থেকে যতটা সম্ভব দূরে থাকতে নির্দেশ দিয়েছে ‘চাণক্য নীতি’।
  • নারী নাকি বিশ্বস্ত হতেই পারে না।
  • নারীর প্রকৃতিতেই নাকি সাতটি ‘দোষ’ বর্তমান— অসত্যভাষণ, নির্বুদ্ধিতা, হঠকারিতা, ছলনা, অর্থলিপ্সা, অপরিচ্ছন্নতা এবং নিষ্ঠুরতা। (এই মন্তব্যের পরে আর কী বাকি থাকে?)
  • ‘চাণক্য নীতি’-র উপদেশ— নারীদের চার দেওয়ালের মধ্যেই রাখুন। বাইরে কদাচ নয়।

এই নীতিমালার এহেন পুরুষতান্ত্রিক চেহারার কারণ একটাই। সেটা সেকালের যুগধর্ম। এখানে কোনও ‘ডেরোগেশন’ খোঁজা ভুল হবে। সেই কালই এমনভাবে দেখতে শিখিয়েছিল নারীকে। এই দর্শনের পিছেন কাজ কেরছিল সেকালের অর্থনীতি, উৎপাদন সম্পর্ক, রাষ্ট্রকাঠামো ইত্যাদিও। ‘চাণক্য নীতি’ সেই অধিকাঠামোরই প্রতিফলন।

“কোনো মানুষেরই পুরোপুরি সৎ হওয়া উচিত নয়। একেবারে সরল খাড়া গাছ যেভাবে সবার আগে কাঁটা হয়, সৎ মানুষ তেমনি সহজে বিপদে পড়ে।”- চাণক্য

আরও পড়ুন:Biography of Buddhist guru Dalai lama || বৌদ্ধ ধর্মগুরু দালাইলামার জীবন কাহিনী

প্রাচীন পৃথিবীর সেরা দার্শনিকদের কথা বলতে গেলে অনেকের নামই বলা যাবে। কিন্তু যদি বলা সেরা দার্শনিক, রাজনীতিবিদ, অর্থনীতিবিদ, তখন অনেক ভেবে একটি নামই বারবার মনে পড়বে। সেটি চাণক্য। এক অর্থশাস্ত্র লিখেই তিনি ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনীতি এবং অর্থনীতির তাবৎ হালচাল বদলে দিয়েছেন। রাষ্ট্রবিজ্ঞান এবং অর্থনীতির মতো ব্যাপারগুলোতে কনফুসিয়াস আর মোজির মতো দার্শনিকের সমপর্যায়েই ভাবা হয় তাকে। শক্তিশালী মৌর্য সাম্রাজ্যের রাজা চন্দ্রগুপ্তের দরবারে মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করা চাণক্যকে ইতিহাসের সবচেয়ে চতুর মন্ত্রীদের একজন বললে অত্যুক্তি হবে না মোটেও। শক্তিশালী নন্দ রাজবংশকে উৎখাত করে পাটালিপুত্রে মৌর্য শাসন দৃঢ় করায় তার অবদান অগ্রগণ্য।

কৌটিল্য (৩৫০-২৮৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দ);

চাণক্য, কৌটিল্য নাকি বিষ্ণুগুপ্ত? তার প্রকৃত নাম নিয়ে বিতর্ক থেকেই যাবে। তবে অধিকাংশের মতে, এই তিনটিই তার ভিন্ন ভিন্ন নাম। এগুলোর মধ্যে কৌটিল্য হচ্ছে তার গোত্রের নাম। মূলত ‘কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র’ বইটির জন্যই তার কৌটিল্য নামটি চলে আসছে। আবার সে বইয়ের এক জায়গায় লেখককে বিষ্ণুগুপ্তও সম্বোধন করা হয়। তাছাড়া, চাণক্যই যে বিষ্ণুগুপ্ত, সে প্রমাণ পাওয়া যায় খ্রিস্টপূর্ব ৩য় অব্দের বিষ্ণু শর্মা নামক কোনো এক লেখকের ‘পঞ্চতন্ত্র’ নামক একটি সংস্কৃত লেখায়। খুব কমসংখ্যক ইতিহাসবিদই মনে করেন যে চাণক্য এবং কৌটিল্য আলাদা ব্যক্তি। আবার কেউ কেউ বলেন যে চাণক্য ও কৌটিল্য একই ব্যক্তি হলেও বিষ্ণুগুপ্ত আলাদা মানুষ। বিষ্ণুগুপ্তকে অর্থশাস্ত্রের সম্পাদক বলে অভিহিত করেন অনেকে।

চাণক্যের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে আলোচনা শুরুর পূর্বেই উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, আজ থেকে প্রায় ২৩০০ বছর আগের ইতিহাস খুব একটা বিশুদ্ধভাবে লিখিত নেই। প্রতিটি ক্ষেত্রেই ইতিহাসবিদগণের মধ্যে রয়েছে মতপার্থক্য এবং বিতর্ক। তথাপি এখানে সর্বাধিক স্বীকৃত তথ্যগুলোই সংযোজনের চেষ্টা করা হয়েছে।

আনুমানিক ৩৫০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে প্রাচীন ভারতের গোল্লা নামক অঞ্চলের চানাকা নামক এক গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন চাণক্য। তার পিতা চানিন এবং মাতা চানেশ্বরী ছিলেন ব্রাহ্মণ। তাই চাণক্যও জন্মসূত্রেই ব্রাহ্মণ ছিলেন। তবে জৈন ইতিহাসবিদ হেমাচন্দ্রের মতে চাণক্যের পিতার নাম ছিল চাণক। যা-ই হোক, চাণক্যের বাবা একজন শিক্ষক ছিলেন। তাই শৈশব থেকেই তিনি নিজের সন্তানের শিক্ষার উপর যথেষ্ট গুরুত্ব দেন। সে সময় বেদকে মনে করা হতো শিক্ষাক্ষেত্রে কঠিনতম বিদ্যা। বালক চাণক্য সম্পূর্ণ বেদ অর্থসহ মুখস্থ করে সকলকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন। প্রাচীন ভারতের দক্ষিণ পশ্চিমে (বর্তমানে পাকিস্তানের অন্তর্গত) অবস্থিত তক্ষশীলা ছিল তৎকালীন পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ জ্ঞানচর্চার স্থান। সেখানেই শুরু হয় চাণক্যের পড়ালেখা।

বেদ শিক্ষা হয়ে গেলে রাজনীতি পড়তে শুরু করেন চাণক্য। শৈশব থেকেই চতুর বালক চাণক্য রাজনীতি এবং রাষ্ট্রনীতির অধ্যয়ন বেশ উপভোগ করতেন। কৈশোরে পদার্পণ করেই অর্থনীতি নিয়ে লেগে গেলেন। তক্ষশীলার শিক্ষকদের মধ্যে তার প্রতিভার চর্চা শুরু হয় তখন থেকেই। একে একে সাহিত্য, যুদ্ধশাস্ত্র, চিকিৎসাবিজ্ঞান এবং জ্যোতির্বিজ্ঞানও অধ্যয়ন করেন চাণক্য। খুব সম্ভবত গ্রিক এবং ফারসি ভাষায়ও তার দক্ষতা ছিল। তার রাজনৈতিক কূটকৌশলের কারণে অনেকে তাকে অসৎ মানুষ বলে আখ্যায়িত করলেও, চাণক্য ছিলেন বেশ স্বচ্ছ এক ব্যক্তি। মূলত তিনি ছিলেন বাস্তববাদী। ভারতীয় জীবন দর্শনের সাথে তার আত্মার বন্ধন ছিল। এ কথার সত্যতা পাওয়া যায় তার নীতিশাস্ত্র গ্রন্থে, যেখানে তিনি আদর্শ ভারতীয় ভাবধারায় জীবন ধারণের পন্থা আলোচনা করেন।

তক্ষশীলা সর্বদা সম্ভ্রান্ত এবং রাজবংশীয় শিক্ষার্থীদের পদচারণায় মুখর থাকতো। সেখানকার শিক্ষকগণও ছিলেন অত্যন্ত উঁচু মানের জ্ঞান সম্পন্ন এবং ব্যবহারিক অভিজ্ঞতাসম্পন্ন। সেখানকার পরিবেশই এমন ছিল যে, সেখানে গেলে যে কেউ জ্ঞানার্জন করবেই। রাজা রাজড়াদের সন্তানদের সাথে একত্রে পড়ালেখা করে চাণক্যের মাঝেও বেশ শৌখিন মনোভাব সৃষ্টি হয়। তথাপি, শিক্ষা-দীক্ষা সম্পন্ন করে তিনি সঠিক পথেই পা বাড়িয়েছিলেন। তিনি মনে করতেন, জ্ঞানার্জন করে তা ছড়িয়ে দিতে না পারলে সে জ্ঞান, অনাহারে থাকা অবস্থায় হাঁড়িতে খাদ্য সংরক্ষণ করার মতো। তাই শিক্ষকতাকে নিজের পেশা হিসেবে গ্রহণ করলেন চাণক্য।

“ঈশ্বর ঐ কাঠ, পাথর কিংবা মাটির তৈরি মূর্তির মাঝে বসবাস করেন না। তিনি আমাদের আত্মায় বসবাস করেন!”- চাণক্য

এই নীতিমালার এহেন পুরুষতান্ত্রিক চেহারার কারণ একটাই। সেটা সেকালের যুগধর্ম। এখানে কোনও ‘ডেরোগেশন’ খোঁজা ভুল হবে। সেই কালই এমনভাবে দেখতে শিখিয়েছিল নারীকে। এই দর্শনের পিছেন কাজ কেরছিল সেকালের অর্থনীতি, উৎপাদন সম্পর্ক, রাষ্ট্রকাঠামো ইত্যাদিও। ‘চাণক্য নীতি’ সেই অধিকাঠামোরই প্রতিফলন।

“কোনো মানুষেরই পুরোপুরি সৎ হওয়া উচিত নয়। একেবারে সরল খাড়া গাছ যেভাবে সবার আগে কাঁটা হয়, সৎ মানুষ তেমনি সহজে বিপদে পড়ে।”- চাণক্য

প্রাচীন পৃথিবীর সেরা দার্শনিকদের কথা বলতে গেলে অনেকের নামই বলা যাবে। কিন্তু যদি বলা সেরা দার্শনিক, রাজনীতিবিদ, অর্থনীতিবিদ, তখন অনেক ভেবে একটি নামই বারবার মনে পড়বে। সেটি চাণক্য। এক অর্থশাস্ত্র লিখেই তিনি ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনীতি এবং অর্থনীতির তাবৎ হালচাল বদলে দিয়েছেন। রাষ্ট্রবিজ্ঞান এবং অর্থনীতির মতো ব্যাপারগুলোতে কনফুসিয়াস আর মোজির মতো দার্শনিকের সমপর্যায়েই ভাবা হয় তাকে। শক্তিশালী মৌর্য সাম্রাজ্যের রাজা চন্দ্রগুপ্তের দরবারে মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করা চাণক্যকে ইতিহাসের সবচেয়ে চতুর মন্ত্রীদের একজন বললে অত্যুক্তি হবে না মোটেও। শক্তিশালী নন্দ রাজবংশকে উৎখাত করে পাটালিপুত্রে মৌর্য শাসন দৃঢ় করায় তার অবদান অগ্রগণ্য।


কৌটিল্য (৩৫০-২৮৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দ);

চাণক্য, কৌটিল্য নাকি বিষ্ণুগুপ্ত? তার প্রকৃত নাম নিয়ে বিতর্ক থেকেই যাবে। তবে অধিকাংশের মতে, এই তিনটিই তার ভিন্ন ভিন্ন নাম। এগুলোর মধ্যে কৌটিল্য হচ্ছে তার গোত্রের নাম। মূলত ‘কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র’ বইটির জন্যই তার কৌটিল্য নামটি চলে আসছে। আবার সে বইয়ের এক জায়গায় লেখককে বিষ্ণুগুপ্তও সম্বোধন করা হয়। তাছাড়া, চাণক্যই যে বিষ্ণুগুপ্ত, সে প্রমাণ পাওয়া যায় খ্রিস্টপূর্ব ৩য় অব্দের বিষ্ণু শর্মা নামক কোনো এক লেখকের ‘পঞ্চতন্ত্র’ নামক একটি সংস্কৃত লেখায়। খুব কমসংখ্যক ইতিহাসবিদই মনে করেন যে চাণক্য এবং কৌটিল্য আলাদা ব্যক্তি। আবার কেউ কেউ বলেন যে চাণক্য ও কৌটিল্য একই ব্যক্তি হলেও বিষ্ণুগুপ্ত আলাদা মানুষ। বিষ্ণুগুপ্তকে অর্থশাস্ত্রের সম্পাদক বলে অভিহিত করেন অনেকে।

চাণক্যের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে আলোচনা শুরুর পূর্বেই উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, আজ থেকে প্রায় ২৩০০ বছর আগের ইতিহাস খুব একটা বিশুদ্ধভাবে লিখিত নেই। প্রতিটি ক্ষেত্রেই ইতিহাসবিদগণের মধ্যে রয়েছে মতপার্থক্য এবং বিতর্ক। তথাপি এখানে সর্বাধিক স্বীকৃত তথ্যগুলোই সংযোজনের চেষ্টা করা হয়েছে।

আনুমানিক ৩৫০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে প্রাচীন ভারতের গোল্লা নামক অঞ্চলের চানাকা নামক এক গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন চাণক্য। তার পিতা চানিন এবং মাতা চানেশ্বরী ছিলেন ব্রাহ্মণ। তাই চাণক্যও জন্মসূত্রেই ব্রাহ্মণ ছিলেন। তবে জৈন ইতিহাসবিদ হেমাচন্দ্রের মতে চাণক্যের পিতার নাম ছিল চাণক। যা-ই হোক, চাণক্যের বাবা একজন শিক্ষক ছিলেন। তাই শৈশব থেকেই তিনি নিজের সন্তানের শিক্ষার উপর যথেষ্ট গুরুত্ব দেন। সে সময় বেদকে মনে করা হতো শিক্ষাক্ষেত্রে কঠিনতম বিদ্যা। বালক চাণক্য সম্পূর্ণ বেদ অর্থসহ মুখস্থ করে সকলকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন। প্রাচীন ভারতের দক্ষিণ পশ্চিমে (বর্তমানে পাকিস্তানের অন্তর্গত) অবস্থিত তক্ষশীলা ছিল তৎকালীন পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ জ্ঞানচর্চার স্থান। সেখানেই শুরু হয় চাণক্যের পড়ালেখা।

বেদ শিক্ষা হয়ে গেলে রাজনীতি পড়তে শুরু করেন চাণক্য। শৈশব থেকেই চতুর বালক চাণক্য রাজনীতি এবং রাষ্ট্রনীতির অধ্যয়ন বেশ উপভোগ করতেন। কৈশোরে পদার্পণ করেই অর্থনীতি নিয়ে লেগে গেলেন। তক্ষশীলার শিক্ষকদের মধ্যে তার প্রতিভার চর্চা শুরু হয় তখন থেকেই। একে একে সাহিত্য, যুদ্ধশাস্ত্র, চিকিৎসাবিজ্ঞান এবং জ্যোতির্বিজ্ঞানও অধ্যয়ন করেন চাণক্য। খুব সম্ভবত গ্রিক এবং ফারসি ভাষায়ও তার দক্ষতা ছিল। তার রাজনৈতিক কূটকৌশলের কারণে অনেকে তাকে অসৎ মানুষ বলে আখ্যায়িত করলেও, চাণক্য ছিলেন বেশ স্বচ্ছ এক ব্যক্তি। মূলত তিনি ছিলেন বাস্তববাদী। ভারতীয় জীবন দর্শনের সাথে তার আত্মার বন্ধন ছিল। এ কথার সত্যতা পাওয়া যায় তার নীতিশাস্ত্র গ্রন্থে, যেখানে তিনি আদর্শ ভারতীয় ভাবধারায় জীবন ধারণের পন্থা আলোচনা করেন।

তক্ষশীলা সর্বদা সম্ভ্রান্ত এবং রাজবংশীয় শিক্ষার্থীদের পদচারণায় মুখর থাকতো। সেখানকার শিক্ষকগণও ছিলেন অত্যন্ত উঁচু মানের জ্ঞান সম্পন্ন এবং ব্যবহারিক অভিজ্ঞতাসম্পন্ন। সেখানকার পরিবেশই এমন ছিল যে, সেখানে গেলে যে কেউ জ্ঞানার্জন করবেই। রাজা রাজড়াদের সন্তানদের সাথে একত্রে পড়ালেখা করে চাণক্যের মাঝেও বেশ শৌখিন মনোভাব সৃষ্টি হয়। তথাপি, শিক্ষা-দীক্ষা সম্পন্ন করে তিনি সঠিক পথেই পা বাড়িয়েছিলেন। তিনি মনে করতেন, জ্ঞানার্জন করে তা ছড়িয়ে দিতে না পারলে সে জ্ঞান, অনাহারে থাকা অবস্থায় হাঁড়িতে খাদ্য সংরক্ষণ করার মতো। তাই শিক্ষকতাকে নিজের পেশা হিসেবে গ্রহণ করলেন চাণক্য।

“ঈশ্বর ঐ কাঠ, পাথর কিংবা মাটির তৈরি মূর্তির মাঝে বসবাস করেন না। তিনি আমাদের আত্মায় বসবাস করেন!”- চাণক্য

 

এবার কিছু বিতর্কিত, কিন্তু অতি প্রচলিত তথ্য আলোচনা করা যাক। চন্দ্রগুপ্তের সাথে চাণক্যের সাক্ষাৎ ছিল অনেকটা সিনেমার মতোই। নন্দ রাজবংশের শেষ রাজা ধনানন্দের দরবারে গিয়ে কোনো কারণে অপমানিত হয়ে ফেরেন চাণক্য। আর সে অপমানের বদলা নিতে ধনানন্দকে ক্ষমতাচ্যুত করার ছক কষেন। খুঁজতে থাকেন একজন যোগ্য শিষ্য, যাকে দীক্ষা দিয়ে ধনানন্দকে পরাভূত করা যাবে। এরই ধারাবাহিকতায় তার সাক্ষাৎ হয় চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের সাথে। দীর্ঘদিন চন্দ্রগুপ্তের শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করার পর দুজনের মধ্যে ভালো সম্পর্ক গড়ে ওঠে এবং তারা আরো কয়েকজন আঞ্চলিক শাসকদের সাথে মিলে জোট গড়ে তোলেন। একে তো ধনানন্দকে তার প্রজারা পছন্দ করতো না, তার উপর চাণক্যের চতুর রণকৌশলের সামনে টিকতেই পারলো না নন্দ বাহিনী। আর এরই সাথে নন্দ বংশের পতন ঘটিয়ে চন্দ্রগুপ্তকে সম্রাট করে নতুন সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করা হয়। চাণক্যের প্রখর বুদ্ধিতে এই সাম্রাজ্য বিস্তৃতি লাভ করতে করতে পশ্চিমে সিন্ধু নদী থেকে পূর্বে বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত বিস্তৃতি লাভ করে।

 

“ফুলের সৌরভ কেবলই বাতাসের দিকে ছড়ায়। কিন্তু একজন ভালো মানুষের গুণ চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে।”- চাণক্য

চাণক্যের ব্যাপারে প্রচলিত সবচেয়ে জনপ্রিয় উপকথাটি উল্লেখ আছে জৈন উপকথায়। সেখানে বলা হয় যে, চাণক্য মনে করতেন যেকোনো দিন চন্দ্রগুপ্তের খাবারে বিষ দিয়ে তাকে হত্যা করার প্রচেষ্টা চালাতে পারে শত্রুরা। তাই চন্দ্রগুপ্তের দেহে অনাক্রম্যতা তৈরি করার লক্ষ্যে তিনি প্রতিদিন চন্দ্রগুপ্তের খাবারে অল্প পরিমাণে বিষ মিশিয়ে দিতেন! চন্দ্রগুপ্ত অবশ্য এ ব্যাপারে অবগত ছিলেন না। তিনি অজ্ঞাতসারে বিষ মিশ্রিত খাবার তার গর্ভবতী স্ত্রী দুর্ধরার সাথে ভাগাভাগি করেন, যিনি সন্তান প্রসব থেকে মাত্র কয়েকদিন দূরে ছিলেন। বিষের প্রতিক্রিয়ায় দুর্ধরা মৃত্যুশয্যায় উপনীত হলে তার গর্ভের সন্তানকে বাঁচাতে চাণক্য দুর্ধরার পেট কেটে শিশুটিকে রক্ষা করেন! এই শিশুটিই বিন্দুসার, যিনি চাণক্যের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন এবং চন্দ্রগুপ্তের পরে সিংহাসনে বসে চাণক্যকেই নিজের উপদেষ্টা নিয়োগ করেন।

Read More:ধনী ব্যাক্তিদের সঙ্গে শা’রী’রি’ক সম্পর্কে বাধ্য করানো হত, সমাজের ভয়ে মুখ খোলেননি পরীমণি !

চাণক্যের জীবনের শ্রেষ্ঠ কাজ নিঃসন্দেহে অর্থশাস্ত্র। ২ হাজার বছরের অধিক সময় পেরিয়ে গেলেও অর্থশাস্ত্রের অনেক আলোচনা এখনো সমানভাবে প্রাসঙ্গিক এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। এই বইটিকে একটি বিশ্বকোষ বললেও কম বলা হবে। কী নেই এতে? দর্শনশাস্ত্র, নীতিশাস্ত্র, রাষ্ট্রনীতি, বাজেট ব্যবস্থা, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক (এক প্রদেশের সাথে আরেক প্রদেশের সম্পর্ক), সরকার পরিচালনার নীতি, বাজার ব্যবস্থা, বাণিজ্য, সমরনীতি, খনিজ সম্পদের ব্যবহার, পরিবেশ প্রকৃতি, চিকিৎসাশাস্ত্র, কৃষি এবং রাষ্ট্র পরিচালনায় আরো যত বিষয়ে জ্ঞান থাকা প্রয়োজন, সব! ২৮৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দে এই মহান দার্শনিক এবং রাজনীতিবিদ মৃত্যুবরণ করেন। কীভাবে মৃত্যুবরণ করেছিলেন, তা নিয়ে আছে বিস্তর মতপার্থক্য। সেসবের মধ্যে স্বেচ্ছামৃত্যু, হত্যা, নির্বাসনের মতো ঘটনাও আছে।

চাণক্যের দর্শনের কিছু মূল বিষয় সংক্ষেপে আলোচনা করে শেষ করবো।

১) বিষ না থাকলেও সাপকে বিষধর হবার অভিনয় করতে হবে

একটি সাপকে শত্রুরা ততক্ষণ ভয় পাবে, যতক্ষণ এর দাঁতে বিষ থাকবে। বিষহীন সাপকে যে কেউ ঘায়েল করে ফেলবে। তাই নিজেকে রক্ষার জন্য হলেও সাপকে বিষধর হবার অভিনয় করতে হবে। অন্যকথায়, শত্রুর নিকট নিজের দুর্বলতাগুলো প্রকাশ করা যাবে না।

২) জন্ম হোক যথা তথা, কর্ম হোক ভালো

এই বিখ্যাত নীতিবাক্যটি শৈশব থেকে কতবার শুনেছেন, তার হিসাব আছে? মাধ্যমিকে ভাব সম্প্রসারণে এই বাক্যটির কাটছাঁট করেননি, এমন মানুষ পাওয়া ভার। এই বাক্যটি এসেছিল দার্শনিক চাণক্যের মাথা থেকেই। অবশ্য তিনি ভিন্ন অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে একথা লিখে গেছেন। সে সময় রাজতন্ত্র চালু ছিল এবং রাজ দরবারেও কেবল সম্ভ্রান্ত বংশীয় লোকেরাই কাজ পেত। চাণক্য মনে করতেন রাজতন্ত্র চলতে পারে, কিন্তু রাজ দরবারে রাজার মন্ত্রী উপদেষ্টা হতে হবে যোগ্যতার ভিত্তিতে, বংশের পরিচয়ে নয়।

৩) পুরোপুরি সৎ হওয়া যাবে না

“সততাই সর্বোৎকৃষ্ট পন্থা”  নয়! অন্তত সবসময় নয়, এমনটিই ছিল চাণক্যের বিশ্বাস। বেশিমাত্রায় সৎ এবং সরল হলে মানুষ আপনাকে ব্যবহার করবে, আপনার দুর্বলতার সুযোগ নেবে। আবার ঠোঁটকাটা সততাও কিন্তু মানুষ পছন্দ করে না। আপনার আত্মীয়ের বিয়ে, যেখানে উপস্থিত না হলে তাদের সাথে সম্পর্ক খারাপ হবার সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু অফিসে বিয়ের কথা বললে ছুটি পাবার সম্ভাবনা নেই। তখন কি আপনার গুরুতর কোনো মিথ্যা বলা উচিত? চাণক্যের উত্তর, “হ্যাঁ”। তার কাছে সততা নয়, বরং লৌকিকতাই সর্বোৎকৃষ্ট।

৪) যেকোনো কাজের পূর্বে তিনটি প্রশ্ন

আমি কেন এ কাজটি করবো? এর সম্ভাব্য ফলাফল কী হতে পারে? আমি কি আদতে সফল হবো? যেকোনো কাজের পূর্বে নিজেকে এই ৩টি প্রশ্ন করার উপদেশ দিয়েছেন চাণক্য। চন্দ্রগুপ্তের রাজ্য পরিচালনায়ও তিনি সর্বদা এই নীতি অনুসরণ করেছেন। যে কারণে প্রতিটি কাজের পূর্বে তা নিয়ে হয়েছে বিশদ গবেষণা এবং আলোচনা। ফলে কাজগুলো সম্পন্ন হয়েছে নিপুণভাবে।

৫) ভীতি গ্রাস করার পূর্বেই একে ধ্বংস করে দাও

চাণক্যের একটি চমৎকার ভাবনা হচ্ছে ভীতি এবং সম্ভাব্য সমস্যার সমাধান। যখন আপনি নিশ্চিত যে শীঘ্রই কোনো সমস্যায় পড়তে যাচ্ছেন, তখন সেটি শুরু হবার আগেই ব্যবস্থা নেয়া উচিত। যে ব্যাপারটি আপনাকে ভয় পাইয়ে দিতে পারে বলে মনে করছেন, নিজে ভীত হবার পূর্বেই সে ব্যাপারটি মিটিয়ে ফেলুন। এটাই চাণক্যর উপদেশ। উদাহরণস্বরূপ, আপনি ভয়ে উল্টো দৌড় শুরু করলেই কুকুর সমান আগ্রহে আপনার পিছু নেবে। কিন্তু ভয় না পেয়ে আপনি নিজেই বরং কুকুরটিকে ভয় পাইয়ে দিন, নির্বিঘ্নে হেঁটে চলে যান!

৬) একটি চাকা এককভাবে চলতে পারে না

চাণক্যের রাষ্ট্রনীতি বিষয়ক দর্শনের সবচেয়ে উৎকৃষ্ট ভাবনা এটি। তিনি একটি সরকারকে একটি দ্বিচক্রযানের সাথে তুলনা করেছেন, যেখানে রাজা একটি চাকা এবং তার উপদেষ্টা ও মন্ত্রীরা অপর চাকা। যোগ্য ও বুদ্ধিমান উপদেষ্টা এবং মন্ত্রীপরিষদ ছাড়া রাজা অচল। আবার যথার্থ নেতৃত্বগুণ বিশিষ্ট রাজা ছাড়া মন্ত্রীপরিষদও কোনো কাজ করতে পারবে না। চাণক্য মনে করতেন, রাজার চেয়ে রাজার মন্ত্রীদের অধিকতর জ্ঞানী এবং অভিজ্ঞ হতে হবে যেন তারা রাজাকে ভুল পথে পা বাড়ানো থেকে বিরত রাখতে পারে।

৭) ফলাফলই শেষ কথা।

রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য চাণক্য যেসব নীতি অবলম্বন করার পরামর্শ দিয়েছেন সেগুলো মোটেও নৈতিকতার ধার ধারে না। বরং কার্যকর ফলাফল আনয়নের জন্য যত প্রকার ছল-চাতুরী প্রয়োজন, সবই করতে হবে বলে মনে করতেন চাণক্য। যুদ্ধের সময় প্রতিপক্ষ শিবিরে গুপ্তচর পাঠানো, ঘুষ দিয়ে উচ্চপদস্থ সেনাসদস্যদের হাত করে নেয়া, মধ্যস্থতার কথা বলে ঝোপ বুঝে কোপ দেয়া, শত্রুর শত্রুদের সাথে জোট বাঁধা সহ যা করা প্রয়োজন সবকিছুর পক্ষেই মত দিতেন চাণক্য। এসবের বিনিময়ে ফলাফল নিজের প্রজাদের পক্ষে রাখা চাই, এটিই তার মত।

৮) অন্যের ভুল থেকে শিক্ষা নাও

চাণক্যের আরো একটি চমৎকার দর্শন হচ্ছে অন্যের ভুল থেকে শিক্ষা নেয়ার উপদেশ। তার মতে প্রতিটি মানুষ তার জীবনে কিছু নির্দিষ্ট ভুল করবেই। তবে কেবল নিজের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে শুধরে যাবার আশা করলে, তা হবে দুরাশা। কারণ মানুষ চিরকাল বেঁচে থাকবে না। বরং নিজের ভুলের সাথে সাথে অন্যদের ভুলগুলোতে নজর রাখতে হবে, সেখান থেকে শিখে নিতে হবে করণীয়।

“শ্রেষ্ঠ গুরুমন্ত্র হচ্ছে নিজের গোপনীয়তা কারো কাছে প্রকাশ না করা।”- চাণক্য

 

 

চাণক্যের জীবনের শ্রেষ্ঠ কাজ নিঃসন্দেহে অর্থশাস্ত্র। ২ হাজার বছরের অধিক সময় পেরিয়ে গেলেও অর্থশাস্ত্রের অনেক আলোচনা এখনো সমানভাবে প্রাসঙ্গিক এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। এই বইটিকে একটি বিশ্বকোষ বললেও কম বলা হবে। কী নেই এতে? দর্শনশাস্ত্র, নীতিশাস্ত্র, রাষ্ট্রনীতি, বাজেট ব্যবস্থা, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক (এক প্রদেশের সাথে আরেক প্রদেশের সম্পর্ক), সরকার পরিচালনার নীতি, বাজার ব্যবস্থা, বাণিজ্য, সমরনীতি, খনিজ সম্পদের ব্যবহার, পরিবেশ প্রকৃতি, চিকিৎসাশাস্ত্র, কৃষি এবং রাষ্ট্র পরিচালনায় আরো যত বিষয়ে জ্ঞান থাকা প্রয়োজন, সব! ২৮৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দে এই মহান দার্শনিক এবং রাজনীতিবিদ মৃত্যুবরণ করেন। কীভাবে মৃত্যুবরণ করেছিলেন, তা নিয়ে আছে বিস্তর মতপার্থক্য। সেসবের মধ্যে স্বেচ্ছামৃত্যু, হত্যা, নির্বাসনের মতো ঘটনাও আছে।

চাণক্যের দর্শনের কিছু মূল বিষয় সংক্ষেপে আলোচনা করে শেষ করবো।

১) বিষ না থাকলেও সাপকে বিষধর হবার অভিনয় করতে হবে

একটি সাপকে শত্রুরা ততক্ষণ ভয় পাবে, যতক্ষণ এর দাঁতে বিষ থাকবে। বিষহীন সাপকে যে কেউ ঘায়েল করে ফেলবে। তাই নিজেকে রক্ষার জন্য হলেও সাপকে বিষধর হবার অভিনয় করতে হবে। অন্যকথায়, শত্রুর নিকট নিজের দুর্বলতাগুলো প্রকাশ করা যাবে না।

২) জন্ম হোক যথা তথা, কর্ম হোক ভালো

এই বিখ্যাত নীতিবাক্যটি শৈশব থেকে কতবার শুনেছেন, তার হিসাব আছে? মাধ্যমিকে ভাব সম্প্রসারণে এই বাক্যটির কাটছাঁট করেননি, এমন মানুষ পাওয়া ভার। এই বাক্যটি এসেছিল দার্শনিক চাণক্যের মাথা থেকেই। অবশ্য তিনি ভিন্ন অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে একথা লিখে গেছেন। সে সময় রাজতন্ত্র চালু ছিল এবং রাজ দরবারেও কেবল সম্ভ্রান্ত বংশীয় লোকেরাই কাজ পেত। চাণক্য মনে করতেন রাজতন্ত্র চলতে পারে, কিন্তু রাজ দরবারে রাজার মন্ত্রী উপদেষ্টা হতে হবে যোগ্যতার ভিত্তিতে, বংশের পরিচয়ে নয়।

৩) পুরোপুরি সৎ হওয়া যাবে না

“সততাই সর্বোৎকৃষ্ট পন্থা”  নয়! অন্তত সবসময় নয়, এমনটিই ছিল চাণক্যের বিশ্বাস। বেশিমাত্রায় সৎ এবং সরল হলে মানুষ আপনাকে ব্যবহার করবে, আপনার দুর্বলতার সুযোগ নেবে। আবার ঠোঁটকাটা সততাও কিন্তু মানুষ পছন্দ করে না। আপনার আত্মীয়ের বিয়ে, যেখানে উপস্থিত না হলে তাদের সাথে সম্পর্ক খারাপ হবার সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু অফিসে বিয়ের কথা বললে ছুটি পাবার সম্ভাবনা নেই। তখন কি আপনার গুরুতর কোনো মিথ্যা বলা উচিত? চাণক্যের উত্তর, “হ্যাঁ”। তার কাছে সততা নয়, বরং লৌকিকতাই সর্বোৎকৃষ্ট।

৪) যেকোনো কাজের পূর্বে তিনটি প্রশ্ন

আমি কেন এ কাজটি করবো? এর সম্ভাব্য ফলাফল কী হতে পারে? আমি কি আদতে সফল হবো? যেকোনো কাজের পূর্বে নিজেকে এই ৩টি প্রশ্ন করার উপদেশ দিয়েছেন চাণক্য। চন্দ্রগুপ্তের রাজ্য পরিচালনায়ও তিনি সর্বদা এই নীতি অনুসরণ করেছেন। যে কারণে প্রতিটি কাজের পূর্বে তা নিয়ে হয়েছে বিশদ গবেষণা এবং আলোচনা। ফলে কাজগুলো সম্পন্ন হয়েছে নিপুণভাবে।

৫) ভীতি গ্রাস করার পূর্বেই একে ধ্বংস করে দাও

চাণক্যের একটি চমৎকার ভাবনা হচ্ছে ভীতি এবং সম্ভাব্য সমস্যার সমাধান। যখন আপনি নিশ্চিত যে শীঘ্রই কোনো সমস্যায় পড়তে যাচ্ছেন, তখন সেটি শুরু হবার আগেই ব্যবস্থা নেয়া উচিত। যে ব্যাপারটি আপনাকে ভয় পাইয়ে দিতে পারে বলে মনে করছেন, নিজে ভীত হবার পূর্বেই সে ব্যাপারটি মিটিয়ে ফেলুন। এটাই চাণক্যর উপদেশ। উদাহরণস্বরূপ, আপনি ভয়ে উল্টো দৌড় শুরু করলেই কুকুর সমান আগ্রহে আপনার পিছু নেবে। কিন্তু ভয় না পেয়ে আপনি নিজেই বরং কুকুরটিকে ভয় পাইয়ে দিন, নির্বিঘ্নে হেঁটে চলে যান!

৬) একটি চাকা এককভাবে চলতে পারে না

চাণক্যের রাষ্ট্রনীতি বিষয়ক দর্শনের সবচেয়ে উৎকৃষ্ট ভাবনা এটি। তিনি একটি সরকারকে একটি দ্বিচক্রযানের সাথে তুলনা করেছেন, যেখানে রাজা একটি চাকা এবং তার উপদেষ্টা ও মন্ত্রীরা অপর চাকা। যোগ্য ও বুদ্ধিমান উপদেষ্টা এবং মন্ত্রীপরিষদ ছাড়া রাজা অচল। আবার যথার্থ নেতৃত্বগুণ বিশিষ্ট রাজা ছাড়া মন্ত্রীপরিষদও কোনো কাজ করতে পারবে না। চাণক্য মনে করতেন, রাজার চেয়ে রাজার মন্ত্রীদের অধিকতর জ্ঞানী এবং অভিজ্ঞ হতে হবে যেন তারা রাজাকে ভুল পথে পা বাড়ানো থেকে বিরত রাখতে পারে।

৭) ফলাফলই শেষ কথা।

রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য চাণক্য যেসব নীতি অবলম্বন করার পরামর্শ দিয়েছেন সেগুলো মোটেও নৈতিকতার ধার ধারে না। বরং কার্যকর ফলাফল আনয়নের জন্য যত প্রকার ছল-চাতুরী প্রয়োজন, সবই করতে হবে বলে মনে করতেন চাণক্য। যুদ্ধের সময় প্রতিপক্ষ শিবিরে গুপ্তচর পাঠানো, ঘুষ দিয়ে উচ্চপদস্থ সেনাসদস্যদের হাত করে নেয়া, মধ্যস্থতার কথা বলে ঝোপ বুঝে কোপ দেয়া, শত্রুর শত্রুদের সাথে জোট বাঁধা সহ যা করা প্রয়োজন সবকিছুর পক্ষেই মত দিতেন চাণক্য। এসবের বিনিময়ে ফলাফল নিজের প্রজাদের পক্ষে রাখা চাই, এটিই তার মত।

৮) অন্যের ভুল থেকে শিক্ষা নাও

চাণক্যের আরো একটি চমৎকার দর্শন হচ্ছে অন্যের ভুল থেকে শিক্ষা নেয়ার উপদেশ। তার মতে প্রতিটি মানুষ তার জীবনে কিছু নির্দিষ্ট ভুল করবেই। তবে কেবল নিজের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে শুধরে যাবার আশা করলে, তা হবে দুরাশা। কারণ মানুষ চিরকাল বেঁচে থাকবে না। বরং নিজের ভুলের সাথে সাথে অন্যদের ভুলগুলোতে নজর রাখতে হবে, সেখান থেকে শিখে নিতে হবে করণীয়।

“শ্রেষ্ঠ গুরুমন্ত্র হচ্ছে নিজের গোপনীয়তা কারো কাছে প্রকাশ না করা।”- চাণক্য

প্রাচীন বারতে নারী কতটা বন্ধনে ছিল, জানায় ‘চাণক্য নীতি’।

 

ডেইলি নিউজ টাইমস বিডি ডটকম (Dailynewstimesbd.com)এর ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব ও ফেসবুক পেইজটি ফলো করুন করুন।

Leave a Reply