ভার্জিনিয়া: বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটেছিল পাঁচ বছর আগেই। কিন্তু আইনি লড়াইয়ে ইতি পড়েনি। বরং গার্হস্থ্য হিংসা (Domestic Violence), যৌন নির্যাতন (Sexual Violence), এমনকি ধর্ষণের মতো গুরুতর অভিযোগ ওঠে। দীর্ঘ টানাপোড়েনের পর বুধবার কার্যতই পুনর্জীবন পেলেন জনপ্রিয় হলিউড তারকা জনি ডেপ (Johnny Depp)। প্রাক্তন স্ত্রী অ্যাম্বার হার্ডের (Amber Heard) বিরুদ্ধে আনা মানহানি মামলায় আদালতের রায় তাঁর পক্ষেই গিয়েছে। অ্যাম্বার জনিকে কালিমালিপ্ত করতে চেয়েছিলেন বলে মেনে নিয়েছে আদালত (Johnny Depp vs Amber Heard Defamation Case)। একই সঙ্গে জনির আইনজীবীরাও অ্যাম্বারের নামে কুৎসা করেছেন বলেও জানানো হয়।
কিন্তু জনির ভাবমূর্তি নষ্ট করতে, তাঁর দুর্নাম করাই যে লক্ষ্য ছিল অ্যাম্বারের, তা মেনে মেনে নিয়েছে আদালত (Hollywood News)।
দীর্ঘ টানাপোড়েনের পর জয়
দীর্ঘ ছ’সপ্তাহ ধরে সওয়াল-জবাবের পর বুধবার জনি এবং অ্যাম্বারের পরস্পরের বিরুদ্ধে আনা মামলায় রায় দেয় নর্দ্যার্ন ভার্জিনিয়া কাউন্টি সার্কিট কোর্ট। তাতে আদালত জানায়, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে জনির বিরুদ্ধে নির্যাতনের অভিযোগ এনেছিলেন অ্য়াম্বার। নিজেকে নির্যাতিতা হিসেবে দেখাতে চেয়েছিলেন। জনির মান-সম্মান এবং ভাবমূর্তি নষ্ট করাই লক্ষ্য ছিল তাঁর। প্রাক্তন স্ত্রীর বিরুদ্ধে জনি যে মানহানির মামলা দায়ের করেছেন, তা সম্পূ্র্ণ ভাবে বৈধ। সেই কারণে জনিকে দেড় কোটি ডলার ক্ষতিপূরণ দিতে হবে অ্যাম্বারকে, ভারতীয় মুদ্রায় যা প্রায় ১১৬ কোটি টাকা।
মানহানির জন্য ১ কোটি ডলার এবং শাস্তিমূলক অভিযোগ আনার জন্য জনিকে আরও ৫০ লক্ষ ডলার ক্ষতিপূরণ দেওয়ার নির্দেশ দেয় আদালত। কিন্তু ভার্জিনিয়ার স্থানীয় আইন অনুযায়ী, মানহানি মামলার ক্ষেত্রে ক্ষতিপূরণের অঙ্ক ৩ লক্ষ ৫০ হাজার ডলারেই সীমাবদ্ধ, ভারতীয় মুদ্রায় যা প্রায় ২৭ কোটি টাকা। তাই ওই ২৭ কোটি টাকা বাদ দিয়ে বাকিটা পাবেন জনি। একই ভাবে, মামলা চলাকালীন জনির আইনজীবীরা অ্যাম্বারের বিরুদ্ধে কুৎসা করেন, তার জন্য ক্ষতিপূরণবাবদ অ্যাম্বারকে ২০ লক্ষ ডলার দিতে হবে বলে জানায় আদালত, ভারতীয় মুদ্রায় যা প্রায় ১৫ কোটি টাকা।
মেরেকেটে ১৫ মাসের দাম্পত্যজীবন ছিল জনি এবং অ্যাম্বারের। বিবাহ বিচ্ছেদের জন্য় আবেদন করতে গিয়ে জনির বিরুদ্ধে একাধিক গুরুতর অভিযোগ আনেন অ্যাম্বার। নিত্যদিন জনি তাঁকে মারধর করতেন, মাদকের নেশায় ভাঙচুর চালাতেন বাড়িতে, এমন একাধিক অভিযোগ করেন তিনি। প্রমাণস্বরূপ এলোমেলো অবস্থায় জনির একাধিক ছবি, ভিডিও জমা দেন তিনি। শারীরিক অত্যাচারের প্রমাণ স্বরূপ নিজের কিছু ছবিও জমা দেন, যাতে তাঁর মুখে, হাতে, আঘাতের চিহ্ন দেখা যায়। জনির কাছ থেকে ৭০ লক্ষ ডলার ক্ষতিপূরণ দাবি করেন অ্যাম্বার, যা নিজের জন্য় নয়, একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা এবং শিশু হাসপাতালের মধ্যে ভাগ করে দান করে দেবেন বলে জানান।
আদালতে বিচ্ছেদ মঞ্জুর হওয়ার পর, একাধিক সংবাদমাধ্যমে জনি স্ত্রীকে মারধর করেন বলে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। একটি নামী সংবাদমাধ্যমে নিজেকে গার্হস্থ্য এবং যৌন নির্যাতনের শিকার বলেও উল্লেখ করেন অ্যাম্বার। সেই নিয়ে ব্রিটেনের একটি সংবাদমাধ্যমের বিরুদ্ধে প্রথমে মানহানির মামলা করেন জনি। কিন্তু ২০২০ সালে সেই মামলায় লন্ডনের আদালেত হেরে যান জনি। এর পর ‘পাইরেটস অফ দ্য ক্যারিবিয়ান’ এবং ‘ফ্যানটাস্টিক বিস্টস’-এর মতো বড় বাজেটের ছবি, যাতে জনিকে দেখতেই ভিড় করতেন দর্শক, তা থেকে বাদ দেওয়া হয় বধূ নির্যাতনে অভিযুক্ত তাঁকে। একের পর সংস্থা নিজেদের বিজ্ঞাপন থেকে জনিকে বাদ দেয়।
আরও পড়ুন: রেলস্টেশনে তরুণীকে হেনস্তাকারী সেই নারী গ্রেপ্তার
এর পরই অ্যাম্বারের বিরুদ্ধে মানহানির মামলা করেন জনি। মিথ্যা অভিযোগ এনে সারাজীবন ধরে গড়ে তোলা তাঁর উত্তরাধিকার, ভাবমূর্তি এক নিমেষে অ্যাম্বার শেষ করে দিয়েছেন বলে দাবি করেন জনি। বাবা হিসেবে ছেলেমেয়ের চোখে বধূ নির্যাতনকারী হিসেবে পরিচিত হতে চান না বলে জানান তিনি। এর পর বার বার মামলা করে হেনস্থা করার জন্য জনির বিরুদ্ধে পাল্টা মানহানি মামলা দায়ের করেন অ্যাম্বারও। তার পর থেকে গোটা দুনিয়ার চোখ আটকে ছিল এই মামলায়। সরাসরি আদালতের সওয়াল-জবাব সম্প্রচারিত হয় টেলিভিশনে, যাতে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে জনির পক্ষেই সমর্থন বাড়ে। আদালতে একাধিক ছবি, মেসেজ, অডিও রেকর্ডিং জমা দেন জনি, যাতে অ্যাম্বারই তাঁকে মারধর করতেন বলে দাবি করেন জনিয। একটি অডিও রেকর্ডিংয়ে অ্যাম্বারকে বলতেও শোনা যায়, “স্ত্রীর হাতে মার খাও, বাইরে বলে দেখো, কে তোমাকে বিশ্বাস করে। জনি ডেপ, একজন পুরুষ, স্ত্রীর হাতে অত্যাচারিত, আদালতই বিশ্বাস করে কিনা দেখো।”
শুধু তাই নয়, অ্যাম্বারের ছোড়া ভদকার বোতলের আঘাতে তাঁর হাতের অঙুলের উপরের অংশ কেটে বাদ যায়, তাঁকে হেনস্থা করতে শোওয়ার বিছানায় অ্যাম্বার শৌচকর্ম সেরে রাখেন, প্রতি পদে তাঁকে ছোট করে দেখাতেন, বৃদ্ধ বলে বিদ্রূপ করতেন বলেও অভিযোগ করেন জনি। এমনকি প্রতিশ্রুতি মতো খোরপোষবাবদ টাকার পুরোটা অ্যাম্বার দানও করেননি বলে জানান। আদালতে তার জবাব দিতে গিয়ে কার্যত থতমত খেতে হয় অ্যাম্বারকে। জনি তাঁকে মারধর করতেন, তাতে চোখে-মুখে দাগ থেকে যেত, আগের সেই অভিযোগও প্রমাণ করতে পারেননি অ্যাম্বার। এমনকি দু’জনের মধ্যে কথোপকথনে দেখা যায়, দূরত্ব বজায় রাখতে চাওয়া জনিকে কার্যত নাস্তানাবুদ করেন অ্যাম্বার। তিনি যে জনিকে মারধর করেন বলে একটি অডিও রেকর্ডিংয়ে অ্যাম্বারের স্বীকারোক্তিও শোনা যায়। এমনকি প্রাক্তন প্রেমিকাকেও জনি সিঁড়ি থেকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়েছিলেন বলে অভিযোগ করেন অ্যাম্বার। যদিও আদালেত সাক্ষ্যগ্রহণের সময় জনির সেই প্রাক্তন প্রেমিকা, কেট মস জানান, কখনও তাঁর গায়ে হাত তোলেননি জনি।
মোটা টাকার ক্ষতিপূরণ পাবেন জনি
বিভিন্ন জায়গায়, যে সমস্ত হোটেল, রিসর্টে একসময় থেকেছিলেন জনি এবং অ্যাম্বার, সেখানকার কর্মীরাও জানান, অ্যাম্বারই জনিকে হেনস্থা করতেন। এমনকি গোপনে ক্যামেরা বসিয়ে উত্তেজনার মুহূর্তে তোলা জনির ভিডিও অ্যাম্বারই সংবাদমাধ্যমে ছেড়েছিলেন বলেও সামনে আসে। আদালতে জমা পড়া এই সব প্রমাণ, সাক্ষ্যই মামলার মোড় ঘুরিয়ে দিতে শুরু করে। জনির প্রতি সমর্থন বাড়তে শুরু করে সর্বত্র। এর পর বুধবার রায় শোনায় আদালত, যার পর বিবৃতি প্রকাশ করে জনি বলেন, ‘আজ আদালতের রায়ে পুনর্জন্ম হল আমার।’ রায়ঘোষণা চলাকালী আদালতে উপস্থিত ছিলেন অ্যাম্বার। গোটা পর্বে মাথানীচু করে বসে থাকতে দেখা যায় তাঁকে। রায় ঘোষণার পর যদিও বিবৃতি প্রকাশ করে তিনি জানান, আদালতের রায় হতাশ করেছে তাঁকে। গার্হস্থ্য হিংসার শিকার মহিলাদের জন্য তা মোটেই সুখকর নয়।