Early life of Kazi Nazrul Islam:
বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুলের জন্ম হয় ২৪শে মে ১৮৯৯ সালে, বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমার অন্তর্গত চুরুলিয়া গ্রামে | তাঁর বাবার নাম ছিলো কাজী ফকির আহমদ এবং মায়ের নাম ছিলো জাহেদা খাতুন | কবি ছিলেন তাদের ষষ্ঠতম সন্তান | নজরুল ইসলামের জীবনী |
তাঁর বাবা ছিলেন আসানসোলের এক স্থানীয় মসজিদের ইমাম এবং মা ছিলেন একজন সাধারণ গৃহবধু | নজরুলের তিন ভাইয়ের মধ্যে কনিষ্ঠতম ছিলেন কাজী আলী হোসেন এবং দুই বোনের মধ্যে সবার বড় ছিলেন কাজী সাহেবজান | ছোটবেলায় তাঁর ডাকনাম ছিলো “দুখু মিয়া” যা পরবর্তীকালে সাহিত্য জগতে তাঁর ছদ্মনাম হয়ে ওঠে | তাঁর পারিবারিক অবস্থা প্রথম থেকেই তেমন একটা ভালো ছিলোনা | চরম দারিদ্রের মধ্যেই তাঁর বাল্য, কৈশর ও যৌবন বয়স কাটে | কিন্তু সীমাহীন এই পারিবারিক দুঃখ-দূর্দশার মধ্যেও তিনি আজীবন বাংলা কাব্য ও সাহিত্যচর্চা করে গিয়েছিলেন | কোনো বাঁধাই তাঁকে কোনোদিনও দাবিয়ে রাখতে পারেনি |
Education Life of Kazi Nazrul Islam: তিনি তাঁর পড়াশোনা শুরু করেন গ্রামেরই মসজিদ পরিচালিত একটা ধর্মীয় স্কুল থেকে | সেখানে তিনি কুরআন, ইসলাম ধর্ম, দর্শন এবং ইসলামী ধর্মতত্ত্বের বিষয়ে অধ্যয়ন শুরু করেন |
পরে, ১৯০৮ সালে তার বাবা কাজী ফকির আহমদের মৃত্যু হয় | সেইসময় তার বয়স ছিলো মাত্র নয় বছর । বাবার মৃত্যুর পর পারিবারিক অভাব অনটনের কারণে তাঁর শিক্ষা বাধাগ্রস্থ হয় এবং মাত্র দশ বছর বয়সে তাকে নেমে যেতে হয় জীবিকা অর্জনের কাজে | সেইসময় তিনি মক্তব থেকেই নিম্ন মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন এবং উক্ত মক্তবেই শিক্ষকতা শুরু করেন আর এরপর একইসাথে তিনি কাজ করেন হাজী পালোয়ানের কবরের সেবক এবং মসজিদের আযানদাতা হিসেবে | এইসব শিক্ষার মধ্য দিয়ে তিনি অল্পবয়সেই ইসলাম ধর্মের মৌলিক আচার-অনুষ্ঠান সম্পর্কে ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত হন, যা পরবর্তীকালে বাংলা সাহিত্য তথা সঙ্গীতে ইসলামি ঐতিহ্যের রূপায়ণ করতে সহায়ক হয়ে ওঠে |
আরো পড়ুন:
<iframe title=”YouTube video player” src=”https://www.youtube.com/embed/h99m3uGdNfQ” width=”515″ height=”300″ frameborder=”0″ allowfullscreen=”allowfullscreen”></iframe>
অল্প কিছুদিন এইসব করেই তিনি সেই সমস্ত কাজ করা ছেড়ে দেন এবং নিজেকে শিল্পীরূপে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য বাংলার রাঢ় অঞ্চলের এক ভ্রাম্যমান নাট্যদলে যোগদান করেন | সেই দলের সাথে তিনি বিভিন্ন জায়গায় অনুষ্ঠান করতে যেতেন আর তাদের থেকে অভিনয়, গান ও নাচ প্রভৃতি শিখতেন | এছাড়াও কখনো কখনো নাটকের জন্য গান ও কবিতাও তিনি লিখে দিতেন তাদের সাহায্যের কথা ভেবেই । এখানে একটা কথা তোমায় বলে রাখি যে, কাজী নজরুল ইসলাম কিন্তু শুধুমাত্র ইসলাম ধর্মগ্রন্থই অধ্যায়ন করেননি; সেইসাথে তিনি হিন্দু পুরান ও শাস্ত্রও অধ্যায়ন করেছিলেন | তিনি দুই ধর্মকেই সমানভাবে শ্রদ্ধা করতেন | তাঁর কাছে কোনো ধর্মই ছোট কিংবা বড় ছিলোনা | এইজন্যই হয়তো আমরা তাঁর কবিতা, নাটক ও গানের মধ্যে দুই ধর্মেরই সমন্বয়কে খুঁজে পাই | যাই হোক আবার আগের কথায় ফিরে আসি ! তিনি নাট্যদলে থাকাকালীন প্রচুর লোকসঙ্গীতের রচনা করেন | যারমধ্যে অন্যতম কিছু হলো- দাতা কর্ণ, কবি কালিদাস, আকবর বাদশাহ, রাজপুত্রের গান, মেঘনাদ বধ, বিদ্যাভূতুম প্রভৃতি | এছাড়াও তিনি হিন্দু দেবী কালীকে নিয়ে প্রচুর শ্যামা সঙ্গীতও রচনা করেন সেইসময় | যারজন্য অনেক ইসলাম ধর্মাবলম্বী মানুষ তাঁকে কাফেরও পর্যন্ত বলেছিলো | এই বিষয়ে তিনি একবার বলেন – “আমি শুধু হিন্দু মুসলিমকে এক জায়গায় ধরে নিয়ে হ্যান্ডশেক করানোর চেষ্টা করেছি, গালাগালিকে গলাগলিতে পরিণত করার চেষ্টা করেছি” ১৯১০ সালে নজরুল ইসলাম পুনরায় শিক্ষাজীবনে ফিরে যান | প্রথমে তিনি ভর্তি হন রানীগঞ্জ সিয়ারসোল রাজ স্কুলে এবং পরে মাথরুন উচ্চ ইংরেজি স্কুলে | আজ বর্তমানে অবশ্য মাথরুন উচ্চ ইংরেজি স্কুল “নবীনচন্দ্র ইনস্টিটিউশন” নাম পরিচিতি লাভ করেছে | কিন্তু সেইসব স্কুলে পড়ার পরেও তিনি কোনোটাতেই বেশিদিনের জন্য পড়তে পারেননি | আর্থিক সমস্যাই তাঁর সেখানে পড়াশোনার শেখার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় | তাই ক্লাস সিক্স পর্যন্ত পড়ার পর তাঁকে আবার কাজে ফিরে যেতে হয় |
Soldier life of Kazi Nazrul Islam: এরপর ১৯১৭ সালের শেষদিক থেকে ১৯২০ সাল পর্যন্ত প্রায় আড়াই বছর কাজী নজরুল ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে একজন সেনা হিসাবে কাজ করেন | প্রথমে তিনি কলকাতার ফোর্ট উইলিয়ামে এবং পরবর্তীকালে প্রশিক্ষণের জন্য বর্তমান পাকিস্তানের অন্তর্গত নওশেরা প্রদেশে যান | তারপর যখন তাঁর প্রশিক্ষণ শেষ হয়, তখন তিনি করাচি সেনানিবাসে সৈনিক জীবন কাটাতে শুরু করেন । শোনা যায় তখন নাকি তিনি রেজিমেন্টের পাঞ্জাবী মৌলবীদের থেকে ফারসি ভাষা শেখেন, সঙ্গীতানুরাগী সহসৈনিকদের সঙ্গে দেশি-বিদেশি বাদ্যযন্ত্র সহযোগে সঙ্গীতচর্চা করেন এবং একই সঙ্গে সমানভাবে সাহিত্যচর্চাও করেন । তিনি করাচির সেই সেনানিবাসে বসে রচনা করেন বাউণ্ডুলের আত্মকাহিনী, মুক্তি, ব্যথার দান, ঘুমের ঘোরে নামক ইত্যাদি সব গদ্য ও কবিতা |
এত দূরের এক সেনানিবাসে কাজ করা সত্ত্বেও তিনি কলকাতার বিভিন্ন সাহিত্য পত্রিকার পাঠক ছিলেন এবং গ্রাহকও | তাঁর পছন্দের কিছু সাহিত্য পত্রিকা ছিলো যথাক্রমে- প্রবাসী, ভারতী, মর্ম্মবাণী এবং বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা | অবশেষে ১৯২০ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর, তিনি সেনার জীবন ত্যাগ করে পুণরায় কলকাতায় ফিরে আসেন |
Career of Kazi Nazrul Islam: কলকাতায় ফিরে এসে কাজী নজরুল ইসলাম একইসাথে সাহিত্যিক ও সাংবাদিক জীবন শুরু করেন | কলকাতায় তাঁর প্রথম আশ্রয় ছিল ৩২নং কলেজ স্ট্রীটে বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির অফিসে | তিনি সেই সমিতির অন্যতম কর্মকর্তা মুজফ্ফর আহমদের সঙ্গে অনেক কাজ করেন | এরপর যখন তাঁর সদ্যোরচিত উপন্যাস ‘বাঁধন-হারা’ এবং ‘বোধন’, ‘শাত-ইল-আরব’ ও ‘বাদল প্রাতের শরাব’ নামক প্রভৃতি কবিতা; মোসলেম ভারত, বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা, উপাসনা ইত্যাদি সব নামকরা পত্রিকায় প্রকাশিত হয় তখন তা বাংলা সাহিত্য ক্ষেত্রে এক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে |
Kazi Nazrul Islam as Music Teacher জানা যায়, ১৯২১ সালের অক্টোবর মাসে বোলপুরের শান্তিনিকেতনে নজরুল ইসলাম একবার রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যান | ব্যাস ! তখন থেকে ১৯৪১ সাল পর্যন্ত অর্থাৎ প্রায় কুড়ি বছর, বাংলার এই দুই প্রধান কবির মধ্যে যোগাযোগ ও ঘনিষ্ঠতা অক্ষুণ্ণ থাকে | তাঁরা একে অপরকেই গভীরভাবে শ্রদ্ধা করতেন এবং তৎকালীন রাজনীতি ও সাহিত্য নিয়েও মাঝে মাঝে আলোচনা করতেন বলে শোনা যায় |
আরো পড়ুন:
Marriage Life of Kazi Nazrul Islam: ১৯২১ সালে একবার কবি নজরুল ইসলাম, মুসলিম সাহিত্য সমিতির গ্রন্থ প্রকাশক আলী আকবর খানের সাথে কুমিল্লার বিরজাসুন্দরী দেবীর বাড়িতে যান | আর সেখানেই তিনি প্রমীলা দেবীকে প্রথমবার দেখেন | যার সাথে পরে তিনি প্রেম করেন এবং পরবর্তীকালে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধও হন |
কিন্তু এর আগে নজরুলের বিয়ে ঠিক হয়, আলী আকবর খানের শালী নার্গিস আসার খানমের সাথে | বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর আলী আকবর খান তাঁকে শর্ত দেন ঘরজামাই হিসাবে থাকার জন্য, যেই শর্ত তিনি মোটেই মানেননি | অবশেষে বাসর সম্পন্ন হবার আগেই নার্গিসকে রেখে কুমিল্লা শহরে বিরজাসুন্দরী দেবীর বাড়িতে চলে যান কবি । সেইসময় তিনি একদম অসুস্থ হয়ে পরেছিলেন এবং প্রমিলা দেবীই তাঁকে পরে পরিচর্যা করে সুস্থ করে তোলেন | যখন প্রমিলা দেবী এবং নজরুল ইসলামের সন্তান হয় তখন কবি নিজেই তাদের সন্তানদের নামকরণ বাংলা এবং আরবি উভয় ভাষার সমন্বয়ে করেন | তাঁর সন্তানদের নাম রাখা হয় যথাক্রমে- কৃষ্ণ মুহাম্মদ, অরিন্দম খালেদ, কাজী সব্যসাচী এবং কাজী অনিরুদ্ধ |
Death of Kazi Nazrul Islam: বিয়ের ঠিক কিছু বছর পর থেকেই বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের শারীরিক অবস্থার অবনতি হওয়া শুরু হয় | কিন্তু সেইসময়ও তাঁর অসুস্থতা অনেকবারই ঠিক হয়ে যায় চিকিৎসকদের তত্ত্বাবধানে| কিন্তু ১৯৪২ সালে যখন কবি আরো একবার শারীরিক অসুস্থতার কবলে পরেন তখন তাঁকে আর আগের মতো সুস্থ করা সম্ভব হয়ে ওঠেনি কারণ তিনি বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেন এবং তাঁর মানসিক ভারসাম্যও নষ্ট হয়ে যায় | ১৯৫২ সালে সেইজন্য কবিকে রাঁচির এক মানসিক হাসপাতালে পাঠানো হয় |
সেখানে তিনি চার মাস ছিলেন, কিন্তু তাতেও তাঁর মানসিক অবস্থার সামান্যটুকুও উন্নতি হয়নি | এইভাবেই অনেক চিকিৎসা করানোর পর সবশেষে ধরা পরে যে, কবির মস্তিষ্কে নিউরন ঘটিত সমস্যা হয়েছে আর সেই সমস্যাকে বর্তমান চিকিৎসা ব্যবস্থার দ্বারা ঠিক করা একদম অসম্ভব | তিনি কোনোভাবেই আর সুস্থ হতে পারবেন না | তারপর বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর, ১৯৭২ সালের ২৪শে মে ভারত সরকারের অনুমতি নিয়ে কবি নজরুলকে সপরিবারে বাংলাদেশে নিয়ে আসা হয় | কবির বাকি জীবনটা এরপর বাংলাদেশেই কাটে এবং ১৯৭৬ সালে তাঁকে ও তাঁর পরিবারকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব প্রদান করা হয় | অবশেষে, দীর্ঘ রোগভোগের পর সেই বছরই অর্থাৎ ১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট তারিখে তিনি মৃত্যুবরণ করেন |
আশা করি তুমি “Kazi Nazrul Islam Biography in Bengali” পড়ে নিশ্চই অনেক কিছু সুন্দর তথ্য সম্পর্কে জানতে পেরেছো | পোস্টটা ভালো লেগে থাকলে অবশ্যই একটু Comment করে তোমার মতামত আমায় জানিও | তোমার মূল্যবান মতামত আমাকে বাড়তি অনুপ্রেরণা যোগাতে ভীষনভাবে সাহায্য করে |
নজরুলের সংক্ষিপ্ত জীবনী
কাজী নজরুল ইসলাম (মে ২৪, ১৮৯৯ – আগস্ট ২৯, ১৯৭৬)[১],(জ্যৈষ্ঠ ১১, ১৩০৬ – ভাদ্র ১২, ১৩৮৩ বঙ্গাব্দ), অগ্রণী বাঙালি কবি, বিংশ শতাব্দীর অন্যতম জনপ্রিয় বাঙালি কবি, সঙ্গীতজ্ঞ, সংগীতস্রষ্টা, দার্শনিক, যিনি বাংলা কাব্যে অগ্রগামী ভূমিকার সঙ্গে সঙ্গে প্রগতিশীল প্রণোদনার জন্য সর্বাধিক পরিচিত। তিনি বাংলা ভাষার অন্যতম সাহিত্যিক, দেশপ্রেমী এবং বাংলাদেশের জাতীয় কবি। পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশ – দুই বাংলাতেই তাঁর কবিতা ও গান সমানভাবে সমাদৃত। তাঁর কবিতায় বিদ্রোহী দৃষ্টিভঙ্গির কারণে তাঁকে বিদ্রোহী কবি নামে আখ্যায়িত করা হয়েছে। তাঁর কবিতার মূল বিষয়বস্তু ছিল মানুষের ওপর মানুষের অত্যাচার এবং সামাজিক অনাচার ও শোষণের বিরুদ্ধে সোচ্চার প্রতিবাদ। বিংশ শতাব্দীর বাংলা মননে কাজী নজরুল ইসলামের মর্যাদা ও গুরুত্ব অপরিসীম। একাধারে কবি, সাহিত্যিক, সংগীতজ্ঞ, সাংবাদিক, সম্পাদক, রাজনীতিবিদ এবং সৈনিক হিসেবে অন্যায় ও অবিচারের বিরুদ্ধে নজরুল সর্বদাই ছিলেন সোচ্চার। তাঁর কবিতা ও গানে এই মনোভাবই প্রতিফলিত হয়েছে। অগ্নিবীণা হাতে তাঁর প্রবেশ, ধূমকেতুর মতো তাঁর প্রকাশ। যেমন লেখাতে বিদ্রোহী, তেমনই জীবনে –- কাজেই “বিদ্রোহী কবি”। তাঁর জন্ম ও মৃত্যু বার্ষিকী বিশেষ মর্যাদার সঙ্গে উভয় বাংলাতে প্রতি বৎসর উদযাপিত হয়ে থাকে।
নজরুল এক দরিদ্র মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার প্রাথমিক শিক্ষা ছিল ধর্মীয়। স্থানীয় এক মসজিদে সম্মানিত মুয়াযযিন হিসেবে কাজও করেছিলেন। কৈশোরে বিভিন্ন থিয়েটার দলের সাথে কাজ করতে যেয়ে তিনি কবিতা, নাটক এবং সাহিত্য সম্বন্ধে সম্যক জ্ঞান লাভ করেন। ভারতীয় সেনাবাহিনীতে কিছুদিন কাজ করার পর তিনি সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে বেছে নেন। এসময় তিনি কলকাতাতেই থাকতেন। এসময় তিনি ব্রিটিশ রাজের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ সংগ্রামে অবতীর্ণ হন। প্রকাশ করেন বিদ্রোহী এবং ভাঙার গানের মত কবিতা, ধূমকেতুর মত সাময়িকী। জেলে বন্দী হলে পর লিখেন রাজবন্দীর জবানবন্দী। এই সব সাহিত্যকর্মে সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতা ছিল সুস্পষ্ট। ধার্মিক মুসলিম সমাজ এবং অবহেলিত ভারতীয় জনগণের সাথে তার বিশেষ সম্পর্ক ছিল। তার সাহিত্যকর্মে প্রাধান্য পেয়েছে ভালবাসা, মুক্তি এবং বিদ্রোহ। ধর্মীয় লিঙ্গভেদের বিরুদ্ধেও তিনি লিখেছেন। ছোট গল্প, উপন্যাস, নাটক লিখলেও তিনি মূলত কবি হিসেবেই বেশি পরিচিত। বাংলা কাব্য তিনি এক নতুন ধারার জন্ম দেন। এটি হল ইসলামী সঙ্গীত তথা গজল। এর পাশাপাশি তিনি অনেক উৎকৃষ্ট শ্যামাসংগীত ও হিন্দু ভক্তিগীতিও রচনা করেন। নজরুল প্রায় ৩০০০ গান রচনা এবং অধিকাংশে সুরারোপ করেছেন যেগুলো এখন নজরুল সঙ্গীত বা “নজরুল গীতি” নামে পরিচিত এবং বিশেষ জনপ্রিয়। মধ্যবয়সে তিনি পিক্স ডিজিজে[২] আক্রান্ত হন। এর ফলে আমৃত্যু তাকে সাহিত্যকর্ম থেকে বিচ্ছিন্ন থাকতে হয়। একই সাথে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। বাংলাদেশ সরকারের আমন্ত্রণে ১৯৭২ সালে তিনি সপরিবারে ঢাকা আসেন। এসময় তাকে বাংলাদেশের জাতীয়তা প্রদান করা হয়। এখানেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
কাজী নজরুল ইসলাম (২৫ মে[১] ১৮৯৯ – ২৯ আগস্ট ১৯৭৬; ১১ জ্যৈষ্ঠ ১৩০৬ – ১২ ভাদ্র ১৩৮৩ বঙ্গাব্দ) বাংলাদেশের জাতীয় কবি। তিনি ছিলেন বিংশ শতাব্দীর অন্যতম অগ্রণী বাঙালি কবি, ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, সঙ্গীতজ্ঞ ও দার্শনিক যিনি বাংলা কাব্যে অগ্রগামী ভূমিকা রাখার পাশাপাশি প্রগতিশীল প্রণোদনার জন্য সর্বাধিক পরিচিত। তিনি বাংলা সাহিত্য, সমাজ ও সংস্কৃতি ক্ষেত্রের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব হিসেবে উল্লেখযোগ্য।[১] বাঙালি মনীষার এক তুঙ্গীয় নিদর্শন নজরুল। তিনি । পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশ – দুই বাংলাতেই তার কবিতা ও গান সমানভাবে সমাদৃত। তার কবিতায় বিদ্রোহী দৃষ্টিভঙ্গির কারণে তাকে বিদ্রোহী কবি নামে আখ্যায়িত করা হয়েছে।[২] তার কবিতার মূল বিষয়বস্তু ছিল মানুষের ওপর মানুষের অত্যাচার এবং সামাজিক অনাচার ও শোষণের বিরুদ্ধে সোচ্চার প্রতিবাদ।[৩][৪]
বিংশ শতাব্দীর বাংলা মননে কাজী নজরুল ইসলামের মর্যাদা ও গুরুত্ব অপরিসীম। একাধারে কবি, সাহিত্যিক, সংগীতজ্ঞ, সাংবাদিক, সম্পাদক, রাজনীতিবিদ এবং সৈনিক হিসেবে অন্যায় ও অবিচারের বিরুদ্ধে নজরুল সর্বদাই ছিলেন সোচ্চার। তার কবিতা ও গানে এই মনোভাবই প্রতিফলিত হয়েছে। অগ্নিবীণা হাতে তার প্রবেশ, ধূমকেতুর মতো তার প্রকাশ। যেমন লেখাতে বিদ্রোহী, তেমনই জীবনে – কাজেই “বিদ্রোহী কবি”, তার জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকী বিশেষ মর্যাদার সঙ্গে উভয় বাংলাতে প্রতি বৎসর উদযাপিত হয়ে থাকে।
নজরুল এক দরিদ্র মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার প্রাথমিক শিক্ষা ছিল ধর্মীয়। স্থানীয় এক মসজিদে সম্মানিত মুয়াযযিন হিসেবেও কাজ করেছিলেন। কৈশোরে বিভিন্ন থিয়েটার দলের সাথে কাজ করতে যেয়ে তিনি কবিতা, নাটক এবং সাহিত্য সম্বন্ধে সম্যক জ্ঞান লাভ করেন। ভারতীয় সেনাবাহিনীতে কিছুদিন কাজ করার পর তিনি সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে বেছে নেন। এসময় তিনি কলকাতাতেই থাকতেন। এসময় তিনি ব্রিটিশ রাজের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ সংগ্রামে অবতীর্ণ হন। প্রকাশ করেন বিদ্রোহী এবং ভাঙার গানের মতো কবিতা; ধূমকেতুর মতো সাময়িকী। জেলে বন্দী হলে পর লিখেন রাজবন্দীর জবানবন্দী, এই সব সাহিত্যকর্মে সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতা ছিল সুস্পষ্ট। ধার্মিক মুসলিম সমাজ এবং অবহেলিত ভারতীয় জনগণের সাথে তার বিশেষ সম্পর্ক ছিল। তার সাহিত্যকর্মে প্রাধান্য পেয়েছে ভালোবাসা, মুক্তি এবং বিদ্রোহ। ধর্মীয় লিঙ্গভেদের বিরুদ্ধেও তিনি লিখেছেন। ছোটগল্প, উপন্যাস, নাটক লিখলেও তিনি মূলত কবি হিসেবেই বেশি পরিচিত। বাংলা কাব্যে তিনি এক নতুন ধারার জন্ম দেন। এটি হল ইসলামী সঙ্গীত তথা গজল, এর পাশাপাশি তিনি অনেক উৎকৃষ্ট শ্যামা সংগীত ও হিন্দু ভক্তিগীতিও রচনা করেন। নজরুল প্রায় ৩০০০ গান রচনা এবং অধিকাংশে সুরারোপ করেছেন যেগুলো এখন নজরুল সঙ্গীত বা “নজরুল গীতি” নামে পরিচিত এবং বিশেষ জনপ্রিয়।
মধ্যবয়সে তিনি পিক্স ডিজিজে[৫] আক্রান্ত হন। এর ফলে আমৃত্যু তাকে সাহিত্যকর্ম থেকে বিচ্ছিন্ন থাকতে হয়। একই সাথে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। বাংলাদেশ সরকারের আমন্ত্রণে ১৯৭২ সালে তিনি সপরিবারে ঢাকা আসেন। এসময় তাকে বাংলাদেশের জাতীয়তা প্রদান করা হয়। এখানেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দের ২৪ মে (জ্যৈষ্ঠ ১১, ১৩০৬ বঙ্গাব্দ) ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমার চুরুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন কাজী নজরুল ইসলাম।[১] চুরুলিয়া গ্রামটি আসানসোল মহকুমার জামুরিয়া ব্লকে অবস্থিত। পিতামহ কাজী আমিন উল্লাহর পুত্র কাজী ফকির আহমদের দ্বিতীয় স্ত্রী জাহেদা খাতুনের ষষ্ঠ সন্তান তিনি। তার বাবা ফকির আহমদ ছিলেন স্থানীয় মসজিদের ইমাম এবং মাযারের খাদেম। নজরুলের তিন ভাইয়ের মধ্যে কনিষ্ঠ কাজী আলী হোসেন এবং দুই বোনের মধ্যে সবার বড় কাজী সাহেবজান ও কনিষ্ঠ উম্মে কুলসুম। কাজী নজরুল ইসলামের ডাক নাম ছিল “দুখু মিয়া”। নজরুল গ্রামের স্থানীয় মসজিদে মুয়াজ্জিনের কাজ করেন। মক্তবে (মসজিদ পরিচালিত মুসলিমদের ধর্মীয় স্কুল) কুরআন, ইসলাম ধর্ম, দর্শন এবং ইসলামী ধর্মতত্ত্ব অধ্যয়ন শুরু করেন। ১৯০৮ সালে তার পিতার মৃত্যু হয়, তখন তার বয়স মাত্র নয় বছর। পিতার মৃত্যুর পর পারিবারিক অভাব-অনটনের কারণে তার শিক্ষাজীবন বাধাগ্রস্ত হয় এবং মাত্র দশ বছর বয়সে জীবিকা অর্জনের জন্য কাজে নামতে হয় তাকে।[৬] এসময় নজরুল মক্তব থেকে নিম্ন মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে উক্ত মক্তবেই শিক্ষকতা শুরু করেন। একই সাথে হাজি পালোয়ানের কবরের সেবক এবং মসজিদের মুয়াযযিন (আযান দাতা) হিসেবে কাজ শুরু করেন। এইসব কাজের মাধ্যমে তিনি অল্প বয়সেই ইসলামের মৌলিক আচার-অনুষ্ঠানের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত হবার সুযোগ পান যা পরবর্তীকালে তার সাহিত্যকর্মে বিপুলভাবে প্রভাবিত করে।[১] তিনিই বাংলা সাহিত্যে ইসলামী চেতনার চর্চা শুরু করেছেন বলা যায়।[১]
নজরুলের লেখার খাতার একটি পাতা : “তৌহিদেরই মুর্শিদ আমার মোহাম্মদের নাম”
মক্তব, মসজিদ ও মাজারের কাজে নজরুল বেশি দিন ছিলেন না। বাল্য বয়সেই লোকশিল্পের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে একটি লেটো (বাংলার রাঢ় অঞ্চলের কবিতা, গান ও নৃত্যের মিশ্র আঙ্গিক চর্চার ভ্রাম্যমাণ নাট্যদল)[৭] দলে যোগ দেন। তার চাচা কাজী বজলে করিম চুরুলিয়া অঞ্চলের লেটো দলের বিশিষ্ট উস্তাদ ছিলেন এবং আরবি, ফার্সি ও উর্দূ ভাষায় তার দখল ছিল। এছাড়া বজলে করিম মিশ্র ভাষায় গান রচনা করতেন। ধারণা করা হয়, বজলে করিমের প্রভাবেই নজরুল লেটো দলে যোগ দিয়েছিলেন। এছাড়া ঐ অঞ্চলের জনপ্রিয় লেটো কবি শেখ চকোর (গোদা কবি) এবং কবিয়া বাসুদেবের লেটো ও কবিগানের আসরে নজরুল নিয়মিত অংশ নিতেন। লেটো দলেই সাহিত্য চর্চা শুরু হয়। এই দলের সাথে তিনি বিভিন্ন স্থানে যেতেন, তাদের সাথে অভিনয় শিখতেন এবং তাদের নাটকের জন্য গান ও কবিতা লিখতেন। নিজ কর্ম এবং অভিজ্ঞতার আলোকে তিনি বাংলা এবং সংস্কৃত সাহিত্য অধ্যয়ন শুরু করেন।
একইসাথে হিন্দু ধর্মগ্রন্থ অর্থাৎ পুরাণসমূহ অধ্যয়ন করতে থাকেন। সেই অল্প বয়সেই তার নাট্যদলের জন্য বেশকিছু লোকসঙ্গীত রচনা করেন। এর মধ্যে রয়েছে চাষার সঙ, শকুনীবধ, রাজা যুধিষ্ঠিরের সঙ, দাতা কর্ণ, আকবর বাদশাহ, কবি কালিদাস, বিদ্যাভূতুম, রাজপুত্রের গান, বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁএবং মেঘনাদ বধ।[১] একদিকে মসজিদ, মাজার ও মক্তব জীবন, অপর দিকে লেটো দলের বিচিত্র অভিজ্ঞতা নজরুলের সাহিত্যিক জীবনের অনেক উপাদান সরবরাহ করেছে। নজরুল কালীদেবীকে নিয়ে প্রচুর শ্যামা সঙ্গীত ও রচনা করেন, নজরুল তার শেষ ভাষনে উল্লেখ্য করেন – “কেউ বলেন আমার বানী যবন কেউ বলেন কাফের। আমি বলি ও দুটোর কোনটাই না। আমি শুধু হিন্দু মুসলিমকে এক জায়গায় ধরে নিয়ে হ্যান্ডশেক করানোর চেষ্টা করেছি, গালাগালিকে গলাগলিতে পরিণত করার চেষ্টা করেছি।”
১৯১০ সালে নজরুল লেটো দল ছেড়ে ছাত্র জীবনে ফিরে আসেন। লেটো দলে তার প্রতিভায় সকলেই যে মুগ্ধ হয়েছিল তার প্রমাণ নজরুল লেটো ছেড়ে আসার পর তাকে নিয়ে অন্য শিষ্যদের রচিত গান: “আমরা এই অধীন, হয়েছি ওস্তাদহীন / ভাবি তাই নিশিদিন, বিষাদ মনে / নামেতে নজরুল ইসলাম, কি দিব গুণের প্রমাণ“, এই নতুন ছাত্রজীবনে তার প্রথম স্কুল ছিল রানীগঞ্জের সিয়ারসোল রাজ স্কুল, এরপর ভর্তি হন মাথরুন উচ্চ ইংরেজি স্কুলে যা পরবর্তীতে নবীনচন্দ্র ইনস্টিটিউশন নামে পরিচিতি লাভ করে। মাথরুন স্কুলের তৎকালীন প্রধান শিক্ষক ছিলেন কুমুদরঞ্জন মল্লিক যিনি সেকালের বিখ্যাত কবি হিসেবেও পরিচিত ছিলেন। তার সান্নিধ্য নজরুলের অনুপ্রেরণার একটি উৎস। কুমুদরঞ্জন স্মৃতিচারণ করতে যেয়ে নজরুল সম্বন্ধে লিখেছেন,
যাহোক, আর্থিক সমস্যা তাকে বেশ দিন এখানে পড়াশোনা করতে দেয়নি। ষষ্ঠ শ্রেণী পর্যন্ত পড়ার পর তাকে আবার কাজে ফিরে যেতে হয়। প্রথমে যোগ দেন বাসুদেবের কবিদলে। এর পর একজন খ্রিস্টান রেলওয়ে গার্ডের খানসামা এবং সবশেষে আসানসোলের চা-রুটির দোকানে রুটি বানানোর কাজ নেন। এভাবে বেশ কষ্টের মাঝেই তার বাল্য জীবন অতিবাহিত হতে থাকে। এই দোকানে কাজ করার সময় আসানসোলের দারোগা রফিজউল্লাহ’র সাথে তার পরিচয় হয়। দোকানে একা একা বসে নজরুল যেসব কবিতা ও ছড়া রচনা করতেন তা দেখে রফিজউল্লাহ তার প্রতিভার পরিচয় পান। তিনিই নজরুলকে ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে ময়মনসিংহ জেলার ত্রিশালের দরিরামপুর স্কুলে সপ্তম শ্রেণীতে ভর্তি করে দেন। ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি আবার রানীগঞ্জের সিয়ারসোল রাজ স্কুলে ফিরে যান এবং সেখানে অষ্টম শ্রেণী থেকে পড়াশোনা শুরু করেন। ১৯১৭ সাল পর্যন্ত এখানেই পড়াশোনা করেন। ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দের শেষদিকে মাধ্যমিকের প্রিটেস্ট পরীক্ষার না দিয়ে তিনি সেনাবাহিনীতে সৈনিক হিসেবে যোগ দেন। এই স্কুলে অধ্যয়নকালে নজরুল এখানকার চারজন শিক্ষক দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। এরা হলেন উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের সতীশচন্দ্র কাঞ্জিলাল, বিপ্লবী চেতনাবিশিষ্ট নিবারণচন্দ্র ঘটক, ফার্সি সাহিত্যের হাফিজ নুরুন্নবী এবং সাহিত্য চর্চার নগেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়।[১]
ডেইলি নিউজ টাইমস বিডি ডটকম (Dailynewstimesbd.com)এর ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব ও ফেসবুক পেইজটি ফলো করুন করুন।