“কেরোসিন শিখা বলে মাটির প্রদীপে, ভাই বলে ডাক যদি দিব গলা টিপে। হেন কালে গগনেতে উঠিলেন চাঁদা, কেরোসিন শিখা বলে, এসো মোর দাদা।”

উল্লেখিত ভাবসম্প্রসারটি আমরা সকলেই শিক্ষা জীবনে কোন না কোন শ্রেণিতে পড়েছি।পরীক্ষায় এসেছে। স্যারদের নির্দেশমত মুখস্ত করে পরীক্ষার খাতায় উগরে দিয়েছি। ভালোমত উগরে দিতে পারায় পরীক্ষায় ভালো নম্বরও পেয়েছি। সত্যিকার অর্থে এর অর্থ কী অনুধাবন করতে পেরেছি? অর্থ অনুধাবন করে নিজের জীবন বা সমাজ জীবনে বা কর্মক্ষেত্রে কী তার প্রয়োগ ঘটাতে পেরেছি।যদি নাই পারি তবে কারিকুলামে এ শিক্ষা রেখে লাভ কী?

শিক্ষক বলতে আমরা স্বাভাবিক অর্থে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের পাঠদানের জন্য নিয়োজিত ব্যাক্তিদের বুঝি। সেই অর্থে কিন্ডারগার্টেন, প্রাথমিক বিদ্যালয়, মাধ্যমিক বিদ্যালয়, উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়,কলেজ,
বিশ্ববিদ্যালয়ে যারাই শিক্ষার্থীদের পাঠদানের জন্য নিয়োজিত সবাই শিক্ষক। যে যার যোগ্যতা অনুযায়ী পাঠদান করান।সবাই শিক্ষক হলেও আমরা নিজেরাই নিজেদের মধ্যে বিভেদ তৈরি সমাজে প্রকাশ করছি। নিজেকে অন্যের তুলনায় বড় জাহির করার জন্য অন্যকে ছোট করি।তুলনামূলক বড়কে বেশি তোয়াজ করি,ছোটকে সমগোত্রীয় পরিচয় দিতে লজ্জা লাগে। শিক্ষকদের মধ্যে ছোটো বড় দ্বন্দ্ব লেগেই আছে।সব চেয়ে বেশি বিভেদ তৈরি করে সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকবৃন্দ(সেটা সরকারি স্কুলের শিক্ষক হউক বা সরকারি কলেজের প্রভাষক হউক) তারা নিজেদেরকে অভিজাত শ্রেণীর শিক্ষক হিসাবে দাবি করেন।এটা এখন এমন পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে যে কেউ কারো ছায়া মারাতেও নারাজ।
সরকারি শিক্ষকবৃন্দ বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকদের ২য় শ্রেণির শিক্ষক মনে করে।তাঁরা নিজেদের অভিজাত শ্রেণির মনেকরার কারণ শিক্ষা অধিদপ্তর, পরিদপ্তর, শিক্ষা বোর্ডসহ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন প্রশাসনিক পদে সরকারি স্কুলের শিক্ষক বা সরকারি কলেজের প্রভাষক, সহযোগী অধ্যাপক, সহকারী অধ্যাপক, অধ্যাপকবৃন্দ প্রেষণে নিয়োগ পেয়েছেন। এখানে যত নিয়মকানুন তৈরি হয়।তাতে তাদের স্বার্থ বিবেচনা করে করে থাকেন।শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শতকরা ৩ ভাগ শিক্ষক সরকারি বাকী ৯৭ ভাগ শিক্ষক বেসরকারি। শিক্ষার্থীদের ৩% বাকী ৯৭% শিক্ষার্থী বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা গ্রহণ করে। শুধু সংখ্যার দিক থেকে নয়, ভালো ফলাফল বিবেচনায়ও বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের অবস্থান ভালো। অনেক দুঃখের সাথে বলতে দেশের মন্ত্রী, সচিবসহ বড় বড় কর্মকর্তাদের বেশির ভাগ বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্র।শিক্ষাগত যোগ্যতায়ও সরকারী ও বেসামরিক শিক্ষকদের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই।
সমকর্ম, সমযোগ্যতা, সমমর্যদায় যোগদান করেও বেসরকারি শিক্ষক সমবেতন পাচ্ছে না।এর কোন ব্যাখ্যা আছে কী?এখানে বেসরকারি শিক্ষকবৃন্দ সরকারি শিক্ষকদের সমগোত্রীয় দাদা বললে তাদের আচরণ কেরসিনের প্রদীপের মত।শিক্ষা প্রশাসনের প্রশাসনিক পদে শিক্ষকদের প্রেসণে নিয়োগ দিতে হবে, এ দাবি আমরা শিক্ষক সমাজ করেছিলাম।সেখানে বেসরকারি শিক্ষকবৃন্দও ছিলেন। কিন্তু প্রাপ্ত সুযোগ সুবিধা সবই সরকারি শিক্ষকবৃন্দ ভোগ করেছে। আমাদের নিয়ন্ত্রণকারী সকল প্রশাসনিক পদে তারা বসে আছেন। বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক কর্মচারীদের মঙ্গলের জন্য কোন প্রস্তাব উঠলে তা যে কোন ভাবে এড়িয়ে যাওয়ার কৌশল তারা বাতলে দেন।সরকারি বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক কর্মচারীদের মধ্যে বিদ্যমান বৈষম্য নিরসনের কোন উদ্যোগ তারা গ্রহণ করেনা। তাদের মতো আমরাও ঐ সকল সুযোগ সুবিধা পেতে পারি সেটা তারা মানতে চায় না। বৈষম্য নিরসনের প্রস্তাবই তারা অগ্রহায়ণ করেনা।
তারাও শিক্ষক আর আমরাও শিক্ষক এ কথাই তারা ভুল যায়। শিক্ষানীতিতে শিক্ষা প্রশাসনের প্রশাসনিক পদে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের মধ্য থেকে ৩০% প্রেষণে নিয়োগ দেওয়ার বিধান আছে। কিন্তু শিক্ষক প্রশাসনের একটি প্রশাসনিক পদেও বেসরকারি শিক্ষকদের প্রেষণে নিয়োগ হয় নাই।দেশের শিক্ষকদের ৩% হল সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের এবং ৯৭% বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের।শুধুমাত্র ৩% সরকারি শিক্ষক থেকে শিক্ষা মন্তনালয় প্রশাসনিক পদ পূরণ করায় তাদের মধ্যে উচ্চাভিলাস কাজ করতে পারে।তারা শিক্ষকতা পেশায় আর মন বসাতে পারছে না।এটা আমাদের কথা নয়।সম্প্রতি কারিগরি ও মাদ্রাসা বিভাগের সচিব জনাব মোঃ আমিনুল ইসলাম খান বলেছেন শিক্ষা ক্যাডার তৈরি করে তাদের উচ্চাভিলাষী করা হয়েছে। এই ক্যাডারের কেউ আর শিক্ষক হতে চায় না। সবাই কর্মকর্তা হতে চায়।
সচিব মহোদয় বক্তব্যে শিক্ষা ক্যাডারের খুব সম্মানে লেগেছে।শিক্ষা ক্যাডার যে সংগঠন আছে তার সচিব মহোদয় কারিগরি ও মাদ্রাসা বিভাগের সচিব মহোদয় বক্তব্যে তীব্র প্রতিবাদ করেছেন।তাদের এ প্রতিবাদ থেকে বুঝা যায় তারা শিক্ষক। তারা যে শিক্ষক সেটা তারা ভুলে নাই।শিক্ষা ক্যাডারের সাথে তাল মিলিয়ে আমরা সচিব মহোদয়ে বক্তব্যের প্রতিবাদ করি।কারণ আমারও চাই শিক্ষা প্রশাসনের প্রশাসনিক পদে শিক্ষা ক্যাডারের শিক্ষকরাই থাকুক। শিক্ষা সংশ্লিষ্ট ব্যাক্তিরাই শিক্ষা ক্ষেত্রের বৈষম্য নিরসন করতে পারবে।আমরা ছোট হলেও তারা আমাদের সমগোত্রীয়।তাঁরা আমাদের কথা একটু হলেও বিবেচনা করবেন।সম্প্রতি শিক্ষা ক্যাডারের লোকজন দ্বারা সংগঠিত দুয়েকটি ঘটনা আমাদের বেশ চিন্তার মধ্যেই ফেলে দিয়েছে।
আমাদের ধারণা ছিল অন্যান্য ক্যাডারের কর্মকর্তাদের থেকে শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তাবৃন্দ আমাদের কষ্টটা ভালো বুঝবে।বাস্তবে দেখা গেল উল্টো। তাঁরা বেমালুম ভুলে যায় তাঁরাও শিক্ষিক।বেসরকারি স্কুলের শিক্ষকদের উৎসব ভাতা যিনি তৈরি করেন তিনিও কিন্তু শিক্ষা ক্যাডারের লোক। নিজের জন্য শতভাগ উৎসব ভাতার বিল তৈরি করে আমাদের বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষিক কর্মচারীদের জন্য তৈরি করেন ২৫% উৎসব ভাতার বিল।নিজের জন্য যেই কলম দিয়ে ৪৫%বা ৬০% বাড়ি ভাড়া বিল প্রস্তুত করেন সেই একই কলমে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক কর্মচারী সবার জন্য সাকুল্যে বাড়ি ভাড়া দেন মাত্র ১০০০ টাকা।
নিজের ছেলে মেয়ের জন্য শিক্ষা ভাতা বিল তৈরি করে বেসরকারি শিক্ষকদের ছেলে মেয়েদের করেন বঞ্চিত। বেসরকারি হলেও আমরা শিক্ষক এটা আপনারা ভুলে জান কী করে? প্রশাসনিক পদে বসে ভুলে যান আপনিও শিক্ষক। কীভাবে বেসরকারি শিক্ষকদের ন্যায্য দাবির আদায়ের আবেদন ফাইল অগ্রহায়ণ না করে নিজের উচ্চাভিলাসের ফাইল অগ্রহায়ণ করেন।
এখন পর্যন্ত প্রশাসন ক্যাডার থেকে আপনাদের উচ্চাভিলাসী বলা হয়েছে। বঞ্চিত ৯৭% শিক্ষক একসময় আপনাদের বিপক্ষে দাঁড়াবে।সময় থাকতে বেসরকারি শিক্ষক ও সরকারি শিক্ষকদের মধ্যকার বৈষম্য নিরসন করে মনেপ্রানে সবাই শিক্ষক হই।যার যেটুকু সম্ভব শিক্ষায় অবদান রাখি।বেসরকারি শিক্ষকদের বঞ্চত করে, শিক্ষকদের মধ্যে ঐক্য ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়।
শিক্ষকদের মধ্যে ঐক্য ফিরিয়ে না এনে কোন ভাবে গুণগত শিক্ষা অর্জন সম্ভব নয়। তাই বলব সমগোত্রীয়কে ভুলে নয় সাথে নিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে হবে। মাটির প্রদীপ, কেরোসিনের প্রদীপ চাঁদ সবাই যেমন আলো দেয় ঠিক তেমনি ভাবে সরকারি শিক্ষক ও বেসরকারি শিক্ষক সবাই শিক্ষার্থীদের পাঠদান করান। সবাই শিক্ষক। এ উপলব্ধি আমাদের সবার মধ্যে জাগ্রত হউক এ কামনা করি।
ডেইলি নিউজ টাইমস বিডি ডটকম (Dailynewstimesbd.com)এর ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব ও ফেসবুক পেইজটি ফলো করুন করুন।
দুলাল চন্দ্র চৌধুরী
সাংগঠনিক সম্পাদক
বাংলাদেশ মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রধান পরিষদ

Leave a Reply