নরমাল ডেলিভারির মাধ্যমে ধরণীতে একটি নক্ষত্রের অবতরণের গল্প : Dr. Chhanda Majumder

রাত ১১ টায় নরমাল ডেলিভারির মাধ্যমে জন্ম নিল থিয়েটার শিল্পী মিসেস রেবেকা সুলতানা পলক ও জনপ্রিয় নাট্য ও সংগীতশিল্পী জনাব কামরুজ্জামান রাব্বির প্রথম সন্তান (রাব্বি সাহেবের ইউটিউব চ্যানেলে গেলেই পরিচয় পাবেন এই সৃষ্টিশীল মানুষটির, সেখানে ছড়িয়ে আছে তার অনবদ্য সৃষ্টিসমুহ)।
গল্পের শুরুটা অনেক আগে থেকে। একদিন মিসেস পলক ওর একটা সমস্যার জন্য আমাকে দেখাতে আসে। কি সুন্দর-মায়াবী-চপল-চঞ্চল-প্রাণপ্রাচুর্যে ভরা একটা মেয়ে। এখান থেকেই ডাক্তার আর রোগীর মিষ্টি ভালোবাসার সম্পর্কের শুরু। তখনই পলক আমাকে জানায় – “আমার যখন বাবু হবে আমি আপনাকেই দেখাবো।” এরপর থেকে পলক মাঝে মাঝে বিভিন্ন সমস্যায় আমাকে দেখাতে শুরু করে। পলক আমাকে রোগীও রেফার করে। যার আমি নরমাল ডেলিভারী করাতে পেরেছিলাম। সেখান থেকে ভরসার আর বিশ্বাসের ভিত্তিটা আরো মজবুদ হতে থাকে।

 ডক্টর চন্দনা মজুমদার এর ফেসবুক থেকে সংগৃহীত।

এরমধ্যে সকল কাটা ধন্যকরে পলক কনসিভ করে। আমাকে দেখানো শুরু করে। ওর এমনিতে অ্যাজমার সমস্যা ছিল। সাথে যেন বোনাস সমস্যা হিসেবে খুব ওজন বাড়তে থাকে। পলক নামের ছোট্ট মেয়েটার যেন অল্প দিনে খুব বড় হয়ে যাচ্ছে! হঠাৎ করেই যেন উচ্ছল এক কিশোরী নারী হয়ে উঠতে থাকে! এর পরই মরার উপর খরার ঘা-এর মত ওর গর্ভকালীন ডায়াবেটিস ধরা পরে। পুরো কায়ানত যেন নির্মম-অদ্ভুত এক সাজিস করতে থাকে, যাতে ওর নরমাল ডেলিভারী না হয়। কিন্তু আমি ও আমার টিম ও হারবার পাত্রী নই। শুরু হয় নতুন এক যুদ্ধ। ইনসুলিন দিতে হয় মাঝে মাঝে। বলি ওজনটাকে নিয়ন্ত্রণ করতেন না পারলে যে নরমাল ডেলিভারি করা খুব কষ্টকর হবে। পলক ও প্রচন্ড মানসিক শক্তি নিয়ে সহায়তা করতে থাকে এবং শেষের দিকে এসে বেশ ওজন নিয়ন্ত্রণ করে ফেলে। মায়েরা হয়তো এমনিই হয়, সন্তানের জন্য কতকিছু সয়ে যায়! এরমধ্যে ওর হাজবেন্ড জনাব কামরুজ্জামান রাব্বি সাথে পরিচয় হয়। ওরা চেম্বারে আসা মানেই অনেকখানি আড্ডা। ওরা আমাকে গুগল-ফেসবুক-ইউটিউব ইত্যাদি সম্পর্কে অনেক আইডিয়া দেয়। মিষ্টি সম্পর্কের গভীরতা আরো বাড়তে থাকে।

 ডক্টর চন্দনা মজুমদার এর ফেসবুক থেকে সংগৃহীত।

শেষের দিকে আমি মনে মনে অনেক বিপদে পড়ে যেতে থাকি। বাচ্চা বড় হয়ে যাচ্ছে। পলকের কোনো লেবার পেইনের লক্ষণ নেই। ওরা শুরু থেকেই নরমাল ডেলিভারির কথা বলে আসছে। ৩৮তম সপ্তাহে আমি পলককে পরীক্ষা করি। পেলভিস ভালো আছে। কিন্তু জরায়ুর মুখ এত উপরে আর এত পিছনে আর এতো মোটা যে খুব শিগগিরই নরমাল ডেলিভারির কোন সম্ভাবনাই নেই। কিন্তু বাচ্চা বড় হয়ে যাচ্ছে। উপরি ডায়াবেটিস, ইনসুলিন ও পায়। সাথে মাঝে মাঝে সমস্যার সোনায় সোহাগা অ্যাজমার প্রকোপ দেখা যায়। কি করি??
ওরা কিছুটা বুঝতে পারে। তার পরও হাল ছাড়িনা, কন্ঠ ছাড়ি জোড়ে! সাহস দেই, বলি সৃষ্টিকর্তা ভরসা। বলি বাসায় হাটতে থাকো। স্কোয়াট করতে থাকো। ৩৯ তম সপ্তাহে ভর্তি হয়ে যেতে বলি।
আজ সকালে কোন ব্যথা ছাড়া ভর্তি হয়। Induction দিব। কিন্তু বাচ্চা ভালো আছে তো? কখনো কখনো সিজার করতে দেখা যায় বাচ্চা ভিতরে পায়খানা করে বসে আছে। পলকের আবার ডায়াবেটিস ও আছে।সিটিজি করলাম। রিপোর্ট ভালো। Induction শুরু করলাম। জরায়ুর মুখ সামনে ও একটু খোলা। কিন্তু এত্ত মোটা। একটু আশা, কিন্তু ভিতরে ভিতরে বেশ হতাশা। ওদের বুঝতে দেইনা। উল্টা রোগীর লোকদের আশ্বস্ত করতে থাকি। ওদের কথা, ম্যাডাম যেটা ভাল হয় সেটাই করেন। নেগেটিভ কাউন্সেলিং করলে ওরা এখনই সিজার করতে চাইবে।
একটু ওচেষ্টা করব না তাই কিভাবে হয়? অনেক সময় তো এভাবেই হয়ে যায়। দুপুর দু’টা থেকে পলকের ব্যথা হতে শুরু করে। এরপর ব্যথা বাড়তে থাকে। সন্ধ্যে ৬ টা নাগাদ অনেক বেশি ব্যথা হয়ে যায়। সন্ধ্যা সাতটার দিকে রাব্বি আমাকে জানায় ম্যাডাম পলকের অনেক বেশি ব্যথা হচ্ছে। পলক এখনই অনেক ভেঙে পড়েছে। পরীক্ষা করে দেখা যায় ৩ সেন্টিমিটার খুলেছে। কিন্তু আসার কথা জরায়ুরর মুখ অনেক পাতলা হয়ে এসেছে। আমি রাব্বিকে জানাই, সারা pregnancy সময় নরমাল ডেলিভারির কথা বলে এলো, এখন ব্যথার জন্য সিজার করলে আর কখনো কিন্তু ওর নরমাল হবে না। তার উপর এটা ওর প্রথম বাচ্চা।ভবিষ্যৎ এ সিজার এর পরে নরমাল ডেলিভারি করালে এতবেশি রিস্ক নেওয়া যাবে না। আমাকে আর একটু সময় দাও। মনে-মনে আমারও ভয়, বাচ্চা আবার পেটের মধ্যে পায়খানা করে দেয় নিতো? আবার সিটিজি করি।
বেজ লাইন Heart rate ১২০। কোন এক্সিলারেশন বা ডিসেলেরেশন নাই। Heart rate কেন কম দেখাচ্ছে?? পরীক্ষা করি আবার। কি সুন্দর! ৫ সেন্টিমিটার খুলেছে। অল্প সময়ে। কিন্তু পানি ভাঙ্গার মত কোন bag of water পাওয়া যাচ্ছে না। পানির রং দেখতে পাচ্ছি না। অক্সিজেন দিচ্ছি এবং স্যালাইন দিচ্ছি। ওরা জানতে পেরেছে হার্টবিট কম। জানতে চাচ্ছে ম্যাডাম বাচ্চা ভালো আছে তো? সহকর্মী ডাক্তাররা বলছে হার্ট বিট কম, সিজার করে ফেলাই ভালো। কিন্তু এত সুন্দর প্রগ্রেস করছে। আমি মনে মনে খুব করে চাচ্ছি যেন নরমাল হয়।
মনে হচ্ছে ভীষন যুদ্ধে আমি একা। জিতলে সবাই জিতবো। হারলে আমি একা হারবো। সবাই আমাকে দোষারোপ করবে। সিটিজি তে যেহেতু ডিসেলেরেশন তাই আমি আরো একঘন্টা রিস্ক নিলাম। একঘন্টা পরে ফাইনাল ডিসিশন নিব।
এর মধ্যে অন্য আরেকটা সিজার শেষ করলাম। শেষের দিকে আমার সহকর্মীকে পাঠালাম চেক করার জন্য। এসে জানালো জরায়ুর মুখ পুরো খুলে গেছে। মনে মনে
একটা উচ্ছ্বাস তৈরি হচ্ছে। আবার ভয়ও লাগছে বাচ্চা পায়খানা খেয়ে ফেলেনিতো এতক্ষণে??
সবাই দ্রুত ডেলিভারি করানোর জন্য প্রস্তুতি নিলাম।
রাত এগারোটায় নরমাল ডেলিভারির মাধ্যমে ধরায় এলো অদ্ভুত সুন্দর স্বর্গের পরী। পলকের কন্যার দিকে এক মুহূর্ত অপলক তাকিয়ে থেকে সবার অলক্ষ্যে মুখে একটা সার্থক-বিজয়ের হাসি ফুটল। আহা, কী যুদ্ধটাই না গেল তোকে নিয়ে আসতে! দোয়া রাশি রাশি! ♥
যুদ্ধে সবাই জয়ী হলাম। সবাই আশীর্বাদ করবেন। এভাবে জেনো একটার পর একটা যুদ্ধে জয়ী হতে পারি।
সবাই অনেক ভরসা করছে। সারা বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা থেকে নরমাল ডেলিভারি করানোর জন্য ছুটে আসছে আমার কাছে। আমি যেন তাদের ভরসা জায়গাটা ধরে রাখতে পারি। পারা না পারা আমার হাতে না। চেষ্টায় যেন কখনো গাফিলতি না করি।
আজকে আমার কাছে আসা আরেকটা রোগীর কথা দিয়ে আজকে এখানেই শেষ করি। ম্যাডাম এমন কিছু প্রেসক্রিপশনে লিখে দেন যেন প্রতি মাসেই আপনার কাছে একবার অন্তত আসতে হয়। আপনার কাছে আসলে এত রিলাক্স লাগে!!! সারা দুনিয়ায় এত প্রেসার!!!
এই ভালবাসার ওজন কোন পাল্লায় মাপি, কী সাধ্যি আমার!!! ♥♥

 ডক্টর চন্দনা মজুমদার এর ফেসবুক থেকে সংগৃহীত।

ডক্টর চন্দনা মজুমদার এর ফেসবুক থেকে সংগৃহীত।

Leave a Reply