হযরত মুহাম্মদ (স) এর জীবনী ও জীবন কাহিনী | Hazrat muhammad-পাঁচটি রচনা শেষ নবীর জীবনী ২০০ শব্দ, ৩০০ শব্দ,৫০০শব্দ, ১০০০ শব্দ

01.২০০ শব্দ

মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (স.) এর পিতার নাম আব্দুল্লাহ আর মাতার নাম আমিনা। এখানে মহানবী সাঃ এর জীবনী রচনা ৫০০ শব্দ, ৩০০ শব্দেরও বেশী pdf ও তাঁর পুরো পরিচয় বর্ণনা করা হলো-

  • নামঃ মুহাম্মাদ মুস্তফা
  • উপনামঃ আবুল কাসেম
  • উপাধিঃ আল আমিন
  • গোত্রঃ কুরাইশ
  • বংশঃ হাশেমী
  • জন্মঃ ১২ রবিউল আউয়াল সোমবার, ৫৭০ খ্রিঃ
  • জন্মস্থানঃ মক্কা
  • জন্ম সময়ঃ রাত অতিবাহিত হয়ে প্রত্যুষে
  • পিতাঃ আব্দুল্লাহ ইবনে আব্দুল মুত্তালিব
  • মাতাঃ আমিনা বিনতে ওয়াহহাব
  • দুধ মাতাঃ হালিমা
  • দাদাঃ আব্দুল মুত্তালিব
  • দাদিঃ ফাতিমা
  • নানাঃ ওয়াহহাব বিন আবদে মানাফ
  • নানিঃ বোররা বিনতে ওমজা

 হযরত মুহাম্মদ সাঃ এর জন্ম তারিখ

রবিউল আউয়াল মাসের ১২ তারিখ, সোমবার। শুক্লা দ্বাদশীর অপূর্ণ চাঁদ সবেমাত্র অস্ত গিয়েছে। সুবহে সাদিকের সুখ-নূরে পূর্ব  আসমান রাঙা হয়ে উঠেছে। আলো আঁধারের দোল খেয়ে ঘুমন্ত প্রকৃতি  আঁখি মেলেছে।

বৃদ্ধ আব্দুল মুত্তালিব তখন কাবাগৃহে বসে আপন গোত্রের লোকদের সাথে নানা বিষয়ে আলাপ করছিলেন। এমন সময় সংবাদ আসল যে, আমিনা এক পুত্ররত্ন প্রসব করেছেন। হর্ষ  ও বিষাদে আবদুল মুত্তালিবের হৃদয় ভরে গেলো।

সংবাদ পাওয়া মাত্রই তিনি আমিনার গৃহে উপস্থিত হয়ে আব্দুল্লাহ তনয়ের মুখ দর্শন করলেন। কী সুন্দর জ্যোতির্ময় বেহেশতী মুখশ্রী! আব্দুল মুত্তালিবের চোখ জুড়িয়ে গেলো। আকুল আগ্রহে শিশুটিকে কোলে নিয়ে তিনি তৎক্ষণাৎ কাবা প্রাঙ্গণে এসে তার জন্য প্রার্থনা করলেন।

সাতদিন পরে আরবের চিরাচরিত নিয়ম অনুযায়ী আবদুল মুত্তালিব শিশুর আকিকা উৎসব করলেন। মক্কার বিশিষ্ট কোরেশ নেতৃবৃন্দ ও আত্মীয়-স্বজনকে দাওয়াত দেয়া হলো। উৎসব শেষে কোরেশ দলপতিগণ জানতে চাইলেন- শিশুর নাম কী রাখলেন?

“মুহম্মাদ”- কোনো এক অদৃশ্য ইঙ্গিতে আব্দুল মুত্তালিব এই কথা বলে ফেললেন। সকলে শিশুকে আশির্বাদ করে চলে গেলেন।

মহানবী সাঃ এর শৈশবকাল রচনা

হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাই সালাম এর জন্মের কয়েক দিন পরেই মরুভূমি হতে বেদুঈন নারীরা শিশু সন্তানের অনুসন্ধানে মক্কা নগরীর উপনীত হলো। তখনকার দিনে আরবে এটাই ছিল প্রচলিত প্রথা। সম্ভ্রান্ত আরব পরিবারে কোনো শিশু জন্ম নিলে তার স্তন্যদান এবং লালন-পালনের ভার ধাত্রীর হাতে ন্যস্ত করা হতো। অবশ্য এজন্য ধাত্রীকে উপযুক্ত পুরস্কার ও বেতন দেয়া হত।

ধাত্রীদের সকলেই মনের মত এক একটা শিশু সন্তান লাভ করে ফিরে গেল। কিন্তু মোহাম্মদ ছাড়া অন্য কোনো শিশু হালিমার ভাগ্যে জুটলোনা। তখন হালিমা স্বামীকে ডেকে বললেন- শূন্য হাতে ফিরে গিয়ে লাভ কি? এই এতিম শিশুটিকেই গ্রহণ করি, কী বল?

স্বামী উত্তর দিলেন- নিশ্চয়ই, মোহাম্মদকে গ্রহণ করো। ইহার মধ্য দিয়ে আমাদের নসিব বুলন্দ হইবে। হালিমা তখন শিশু মোহাম্মদকে গ্রহণ করলেন।

হালিমার এক পুত্র, তিন কন্যা ছিল। পুত্রের নাম আব্দুল্লাহ এবং কন্যার নাম আনিসা,হোজায়ফা এবং শায়েমা। শায়েমার বয়স তখন সাত-আট বছরের মত। শিশু মুহাম্মাকে লালন-পালনের কাজে সে সর্বদা মাকে সাহায্য করতো। মুহাম্মাদকে সে বড় ভালোবাসতো।

শিশু মুহাম্মাদকে নিজ গৃহে আনার পরে হালিমা এক আশ্চর্য পরিবর্তন লক্ষ্য করলেন। তার গৃহপালিত’ পশুগুলি অধিকতর পরিপুষ্ট হয়ে উঠলো এবং অধিক পরিমাণে দুগ্ধদান করতে লাগলো। খেজুর বৃক্ষে প্রচুর পরিমাণে খেজুর ফলতে লাগল। কোন দিক দিয়ে তার আর কোন অভাব অনুভব হল না।

এভাবে দুই বছর কেটে গেল। হালিমা মোহাম্মদকে আমিনার নিকট নিয়ে আসলেন। আমিনা পুত্রের স্বাস্থ্যোজ্জ্বল মধুর মুরতি ও দিব্যকান্তি দেখে মুগ্ধ হলেন। মনে মনে আল্লাহকে ধন্যবাদ দিতে লাগলেন। হালিমার উপরেও তিনি খুব সন্তুষ্ট হলেন।

এই সময় মক্কায় অত্যন্ত সংক্রামক রোগের প্রাদুর্ভাব হলো। এ কারণে আমিনা মুহাম্মদকে আরো কিছুদিন হালিমার তত্ত্বাবধানে রেখে দেওয়া সঙ্গত মনে করলেন। বৃদ্ধ মুত্তালিবও এই প্রস্তাব সমর্থন করলেন। পুনরায় মোহাম্মদ  হালিমার গৃহে ফিরে চললেন।

হযরত মুহাম্মদ সাঃ এর জীবন কাহিনী

হালিমার গৃহে অবস্থান কালে হযরত মুহাম্মদ এর জীবনে একটি অলৌকিক কান্ড ঘটেছিল। একদিন শিশু মোহাম্মদ তাঁর  দুধভাই ও অন্যান্যদের সাথে মাঠে মেষ চড়াচ্ছিলেন। এমন সময় একজন ফেরেশতা তাদের সম্মুখে আবির্ভূত হলেন। মোহাম্মদের হাত ধরে একটু আড়ালে নিয়ে গেলেন।

তারপর তাকে চিৎ করে শুইয়ে দিয়ে তার বুক চিরে কি যেন বাহির করলো। মুহাম্মদ সংজ্ঞাহীন অবস্থায় পড়ে রইলেন। দূর থেকে এই ব্যাপার লক্ষ্য করে বালকেরা ভয় পেয়ে দৌড়ে গিয়ে হালিমাকে বললেন- দেখ গিয়ে মোহাম্মদ নিহত হয়েছেন। সংবাদ পেয়ে হালিমা এবং তার স্বামী ছুটে এলেন। দেখলেন বাস্তবিকই মুহাম্মাদ অজ্ঞান অবস্থায় পড়ে আছে। তারা কিছুই বুঝতে পারলেন না।। মূলত এটি ছিল তাঁর সিনা সাফ করার একটি ঘটনা।

মহানবী সাঃ এর স্ত্রীদের নাম

হযরত মুহাম্মাদ (স.) তাঁর জীবদ্দশায় মোট ১৩টি বিবাহ করেছেন। বিবি খাদিজা ছাড়া আর বাকি ১২টি বিবাহ করেছেন ৫১-৬৩ বছর বয়সের মধ্যে, বিবি খাদিজার মৃত্যুর পরে। এক সুমহান আদর্শ ও প্রেরণা দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়ে তিনি এতগুলি বিবাহ করেছিলেন। নারীত্বের মর্যাদা দান, পরিজনদের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা অর্জন, অনুরোধ রক্ষা, আদর্শের পূর্ণতা সম্পাদন, কু-সংস্কারের উচ্ছেদ সাধন, আত্ম-ত্যাগের আদর্শ স্থাপন করার জন্যই মূলত তিনি একাধিক বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন।

হযরত মুহাম্মাদ (স.) জীবনে যে সকল নারীকে বিবাহ করেছেন তাদের নামের তালিকা এবং সংক্ষিপ্ত পরিচয় এবং হযরত কোন বয়সে কাকে বিবাহ করেছেন তা নিন্মে দেখানো হলো-

১। খাদিজা ( বিধবা) – হযরতের বয়স তখন ২৫ বছর

২। সাওদা- ( বিধবা) – হযরতের বয়স তখন ৫১ বছর

৩। আয়েশা- কুমারী- হযরতের বয়স তখন ৫২ বছর

৪। হাফসা ( বিধবা) – হযরতের বয়স তখন ৫৪ বছর

৫। জয়নাব বিনতে খোজাইমা ( বিধবা) – হযরতের বয়স তখন ৫৫ বছর

৬। উম্মে সালমা ( বিধবা) – হযরতের বয়স তখন ৫৫ বছর

৭। জয়নব (জায়েদের পরিত্যক্তা স্ত্রী)  – হযরতের বয়স তখন ৫৬ বছর

৮। জওয়ায়েরা ( বিধবা, বনি মুন্তালিক গোত্র) – হযরতের বয়স তখন ৫৬ বছর

৯। রায়হানা (ইহুদিনী, বিধবা) – হযরতের বয়স তখন ৫৭ বছর

১০। মেরী (খ্রিষ্টান, অপহৃতা,  বিধবা) – হযরতের বয়স তখন ৫৭ বছর

১১। সফিয়া ( কিনানার স্ত্রী, বিধবা, ইহুদিনী) – হযরতের বয়স তখন ৫৮ বছর

১২। উম্মে হাবিবা (আবু সুফিয়ানের কন্যা, বিধবা) – হযরতের বয়স তখন ৫৮ বছর

১৩। মায়মুনা (বৃদ্ধা, বিধবা) – হযরতের বয়স তখন ৫৯ বছর

শ্রেষ্ঠ মানুষ : মহানবী হজরত মুহম্মদ (স) – এর জীবন ও জীবনাদর্শ

ভূমিকা :

 সমাজ জীবনে যখন বিশৃঙ্খলা উত্তঙ্গ, কুসংস্কার ও বিচ্ছিন্নতার অশুভ প্রেতনৃত্যে যখন চতুর্দিক আচ্ছন্ন, পরিবেশ যেখানে বিষাক্ত ও কলুষিত, জীবনের সর্বক্ষেত্রেই যখন অবক্ষয়ের লক্ষণ সুস্পষ্ট, অজ্ঞানতার তামসিকতায় মানুষ যখন সুপ্তিমগ্ন, দিশেহারা; তখনই আদর্শভ্রষ্ট মানুষকে তার হতাশা থেকে, রুদ্ধশ্বাস অসহায় অবস্থা থেকে মুক্ত করার জন্যে ধরাধামে আবির্ভাব ঘটে জ্যোতির্ময় মহাপুরুষের। সত্যের জ্যোতিতে বিশ্বলোক হয় উদ্ভাসিত। তাঁদের আদর্শ ও সত্য-দৃষ্টি বিভ্রান্ত মানুষকে মুক্তিমন্ত্রে উজ্জীবিত করে। করে নিত্য-নতুন কল্যাণবোধে উদ্দীপ্ত। এমনি করেই যুগে যুগে কত মহাপুরুষের পুণ্য আবির্ভাবে, অসহায়-পঙ্গু-দুর্বল মানুষ খুঁজে পেয়েছে অন্ধকারে আলো, হতাশায় আশ্বাস, দুঃখে সান্ত্বনা। মধ্যযুগের আরব জাতির জীবনও ছিল এরকমই হতাশা, কুপ্রথা, মূর্তি পূজা, কুসংস্কারের পঙ্কিলতায় আচ্ছন্ন। জড়তাগ্রস্ত, হতাশাচ্ছন্ন ও অন্ধ-তামসিকতামগ্ন আরবজাতিকে মুক্তি দিতে এলেন আল্লাহ-প্রেরিত মহাপুরুষ, মানব মুক্তির দূত হজরত মুহম্মদ (স)। পৃথিবী হল আলোকময়।

হজরত মুহম্মদ (স) ৩০০ শব্দ:

 হজরত মুহম্মদ (স) মহান আল্লাহ-প্রেরিত সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব, মহাপুরুষ, মানব মুক্তির দূত। ইসলামের সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বশেষ নবী হজরত মুহম্মদ (স)। তিনি মানুষের আলোর দিশারি। মানুষের মুক্তি, শান্তি, শিক্ষা ও কল্যাণের জন্য তিনি আজীবন সাধনা করেছেন।

জন্ম ও বাল্যজীবন :

 ৫৭০ খ্রিস্টাব্দে ২৪ আগস্ট (১২ রবিউল আউয়াল), সর্বযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ মানব, আল্লাহর হাবীব, ইসলাম ধর্মের প্রবর্তক ও বিশ্বের আশীর্বাদ হজরত মহম্মদ (স) আরবের এক সম্ভ্রান্ত কুরাইশ বংশে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম আব্দুল্লাহ এবং মাতার নাম বিবি আমেনা। তাঁর জন্মের পূর্বেই পিতা আব্দুল্লাহ ইন্তেকাল করেন। শিশুনবী মহম্মদ (স)-এর ছয় বছর বয়সে তাঁর মাতা হজরত আমেনা ইন্তেকাল করেন। তারপর শিশুনবী পিতামহ আব্দুল মোত্তালিবের স্নেহের ছায়ায় বড় হতে লাগলেন। দাদার স্নেহ-আদরে শিশুনবী পিতামাতার অভাব অনেকটা ভুলে গিয়েছিলেন। ভাগ্যের পরিহাস, দাদা মোত্তালিব তাঁর অত্যন্ত স্নেহভাজন ৮ বছরের নাতী শিশুনবীকে ত্যাগ করে মানবলীলা সংবরণ করেন। এরপর পিতৃব্য আবু তালিব তাঁর লালন-পালনের দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
শৈশব, কৈশরের সততা, কোমল স্বভাব ও অপরিসীম কর্তব্যবোধ, অকৃত্রিম সাধুতা প্রভৃতি গুণাবলির জন্যে তাঁকে সর্বশ্রেণীল লোকজন ‘আল-আমীন বা বিশ্বাসী, উপাধিতে ভূষিত করেন।

বিবাহ :

মক্কার ধনবতী বিধবা মহিলা বিবি খাদিজা (রা) যুবক নবীর সুখ্যাত্বির প্রতি আকৃষ্ট হয়ে তাঁকে নিজ ব্যবসায়ের দায়িত্বভার প্রদান করেন। ক্রমশ তাঁর বিশ্বস্ততার প্রতি অনুরক্ত হয়ে বিবাহের প্রস্তাব দেন। হজরত মুহম্মদ (স) এর বয়স যখন ২৫ বছর তখন তিনি ৪০ বছর বয়স্ক বিবি খাদিজার সঙ্গে প্রণয়সূত্রে আবদ্ধ হন।

নবুয়ত প্রাপ্তি :

 চল্লিখ বছর বয়সে একদিন যখন হেরা পর্বতের গুহায় হজরত মুহম্মদ (স) আল্লাহর গভীর ধ্যানে নিমগ্ন ছিলেন, এমন সময় আল্লাহর আদেশানুসারে ফেরেশতা জিবরাইল (আ) তাঁকে নবুয়তের খোশ খবর দিয়ে অহি অর্পণ করেন। যা তিনি পরবর্তীতে আল্লাহর বাণী হিসেবে কোরানের আকারে মানব সমাজে প্রচান করেন এবং আল-কোরান তাঁর উপরে নাজিল হওয়ার পর থেকে তিনি নবী বা রসূল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলেন। পরবর্তীতে মহম্মদের আদর্শের সাথে একাত্ব ঘোষণা করে কোরানকে যারা স্বীকার করে নেয়, তারা মুসলমান হিসেবে পরিচিত হয়।

ইসলাম প্রচার :

 অহি প্রাপ্তির কিছুদিন পর তিনি আল্লাহর আদেশ প্রাপ্ত হয়ে ইসলাম ধর্ম প্রচার শুরু করেন। তাঁর স্ত্রী বিবি খাদিজা (রা)-ই হলেন ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত প্রথম নারী-মুসলমান। তারপর ইসলাম গ্রহণ করেন কিশোর হজরত আলী (রা) এবং যায়েদ-বিন-হারেস। ক্রমে নবীর আদর্শে উদীপ্ত হয়ে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত মুসলমানদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে লাগল। অন্যদিকে, বিধর্মী কোরাইশগণ ক্ষীপ্ত হয়ে নবীজী ও তাঁর অনুসারীদের বিরুদ্ধে নানারকম অত্যাচার ও উৎপীড়ন শুরু করে দিল। এতদ্সত্ত্বেও ইসলামের জয়যাত্রাকে অক্ষুণ্ণ রেখে তাঁরা তাঁদের সত্যপথ থেকে একবিন্দুও সরে দাঁড়ান নি। বিধর্মীরা ইসলামের প্রসার দেখে ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। একদিন তারা একত্রিত হয়ে পরামর্শ করে যে, তারা হজরত মুহম্মদ (স) কে হত্যা করে তাঁরা প্রবর্তিত ইসলাম ধর্ম প্রচার স্তব্ধ করে দেবে। কিন্তু বিধর্মী কোরাইশ নেতাদের মনষ্কামনা কখনো পূরণ হয় নি।
 

মদিনায় হিজরত :

 কোরাইশদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে মহানবী আল্লাহর আদেশে ৬২২ খ্রিস্টাব্দে মক্কা ত্যাগ করে মদিনায় গমন করেন। মহানবীর এই মদিনা গমনকেই ‘হিজরত’ বলা হয়। মদিনার পূর্বনাম ছিল ইয়াসরিব। হজরত মুহম্মদ (স)-এর মদিনায় আগমনের পর তাঁর সম্মানার্থে এর নাম রাখা হয় ’মদিনাতুন্নবী’ এবং যে-সব মদিনাবাসী তাঁদের আশ্রয় ও সাহায্য করেছিলেন তাঁদেরকে ‘আনসার’ বলা হয়।

মদিনার সনদ :

হজরত মুহম্মদ (স) মুসলমান ও বিধর্মী ইহুদি এবং অন্যান্য সম্প্রদায়ের মধ্যে ঐক্য সৃষ্টির জন্যে এবং মদিনার রক্ষাকল্পে সকলের মধ্যে সম্প্রীতি ও ঐক্য গড়ে তোলার জন্যে যে সনদ প্রস্তুত করেন তা ‘মদিনার সনদ’ নামে খ্যাত। এই সনদকে প্রথম লিখিত শাসনতন্ত্র হিসেবে গণ্য করা হয়। এতে প্রমাণিত হয় যে, রাসূলুল্লাহ (স) শুধু ধর্ম প্রচারকই ছিলেন না, তিনি একজন শ্রেষ্ঠ ও দূরদর্শী রাজনীতিবিদও ছিলেন।

কয়েকটি যুদ্ধ :

 মদিনায় ইসলাম ধর্মের প্রতিষ্ঠা এবং হজরত মুহম্মদ (স) এর প্রভাব ও প্রতিপত্তি বৃদ্ধিতে মক্কার কোরাইশগণ শঙ্কিত ও ঈর্ষান্বিত হয়ে ওঠে। ইসলামী প্রজাতন্ত্র গঠন ও মুসলমানদের আধিপত্য বিস্তারে বিধর্মীরা ইসলাম ধর্ম এবং মুসলমানদের বিরুদ্ধে কয়েকটি যুদ্ধ বা সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। বিধর্মীরা প্রায় সবগুলো যুদ্ধেই পরাজয়বরণ করে। অবশেষে তারা তাদের ভুল বুঝতে পেরে দলে দলে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে। হজরত মুহম্মদ (স)-এর প্রচারিত ইসলাম ধর্মে কোন জাতিভেদ, বর্ণভেদ, উচ্চ-নিচ এবং ধনী-দরিদ্রের ভেদাভেদ নেই। এজন্যেই মহান আল্লাহপাকের এই ধর্ম পৃথিবীর শ্রেষ্ঠধর্ম হিসেবে শেষ অবধি টিকে আছে এবং আজীবন টিকে থাকবে।

মহানবীর জীবনাদর্শ

১। চরিত্র : 

বিশ্বনবী হজরত মুহম্মদ (স) মানবকুলের আদর্শ পুরুষ। তিনি দিব্যকান্তিবিষিষ্ট সুদর্শন পুরুষ ছিলেন। তাঁর অবয়ব থেকে প্রতিভা ও দৃঢ়সংকল্পের যে জ্যোতি স্ফুরিত হত তা সবাইকে মুগ্ধ করত। তাঁর বাক্য এমন কোমল মধুর ও মনোহর ছিল যে, শত্রুরা পর্যন্ত তাঁর আকর্ষণীয় শক্তি অনুভব করে বলতো, “মুহম্মদের বাক্যে ইন্দ্রজাল আছে।” তিনি যেমন আধ্যাত্মিক বিষয়ে তেমনি বাহ্য-বেশ-বিন্যাসের ও আদর্শ স্থানীয় ছিলেন। হজরত মুহম্মদ (স) এমন শিষ্টাচারী ছিলেন যে, কারো সঙ্গে দেখা হলে তিনিই অগ্রবর্তী হয়ে সালাম দিতেন।

২। স্নেহপরায়ণতা :

মহানবী হজরত মুহম্মদ (স) ছোট ছোট ছেলেমেয়েকে অত্যন্ত আদর করতেন, তাদের সঙ্গে মিষ্টি কথা বলতেন এবং সময় সময় তাদের সঙ্গে খেলাও করতেন। একবার নামাজের সিজদা দিবার সময় তাঁর দৌহিত্র শিশু হুসাইন তাঁর ঘাড়ে চড়ে বসেছিলেন। হুসাইনের নেমে যাওয়া পর্যন্ত তিনি অপেক্ষা করে তবে সিজদা থেকে মস্তক উত্তোলন করেন। তিনি অনেক সময় নিজে উট সেজে হাসান-হুসাইনকে সেই উটে চড়াতে ভালবাসতেন।

৩। আত্মসম্মানবোধ :

 মহানবীর আত্মসম্মানবোধ অতিপ্রবল ছিল বলে ভিক্ষাবৃত্তিকে তিনি অতিশয় ঘৃণা করতেন। একসময় এক ভিক্ষুক তাঁর কাছে উপস্থিত হলে, তিনি তাকে একখানা কুঠার দান করে বলেছিলেন, “এটা নিয়ে কাঠ কেটে তাই বিক্রি করে জীবন ধারণ করবে।” এছাড়া, তিনি কারো দান গ্রহণ করতেন না। পারস্য দেশের এক কৃষক সন্তান সালমান নবীজীর এই মহান গুণ দেখে তাঁকে চিনতে পেরে তাঁর ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয়েছিলেন।

৪। বৈশিষ্ট্য :

 “মানুষ মানুষের ভাই, পরস্পর সমান” -এই নীতিবাক্য তিনি কেবল মুখেই প্রচার করেন নি, কার্যেও তার ভুরি ভুরি প্রমাণ দিয়ে গেছেন। তিনি দাস-দাসীর কাছ থেকে সেবা গ্রহণ করতেন, তাদেরও তেমনি সেবা করতেন। অনেক সময় দাসকে উটে চড়িয়ে নিজে পদব্রজে চলতেন।

৫। চরিত্রিক দৃঢ়তা :

 হজরত মুহম্মদ (স) ছিলেন সংকল্পে অটল, অবিচল; কোন প্রকার লোভ, অত্যাচার, ক্ষমতা-মোহ কিছুই তাঁকে সংকল্প থেকে বিচ্যুত করতে পারে নি এবং সমুদয় বাধা-বিঘ্ন অতিক্রম করে নিজের জীবনকে তাই তিনি সুষমামণ্ডিত করতে পেরেছিলেন। তাঁর অন্তঃকরণে ছিল দুর্জয় সাহস বিপৎপাতে অসীম ধৈর্য, বিপন্মুক্তিতে চিত্তপ্রসাদ -এসব মহৎ গুণের প্রভাবেই তিনি পৃথিবীর সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মানব হিসেবে পরিগণিত হয়ে আছেন।

৬। ক্ষমা :

 ক্ষমার প্রশ্নে মুহম্মদ পৃথিবীর বুকে এক অতুলনীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন। তাঁর প্রাণঘাতী শত্রুকে পর্যন্ত বারবার হাতের মুঠোয় পেয়েও তিনি তাদের ক্ষমার স্নিগ্ধ স্পর্শ থেকে বঞ্চিত করেন নি। মক্কা বিজয়ে প্রাক্কালে যখন শত্রুপক্ষ প্রাণের আশঙ্কায় বিচলিত, মুহম্মদ তাঁর চিরাচরিত স্বভাবধর্ম অনুযায়ী তাদের সবাইকে ক্ষমা করে বিশ্বের দরবারে ক্ষমার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন।

৭। সংস্কার :

 মুহম্মদের সবচেয়ে বড় পরিচয় হল তিনি পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে সার্থক এবং বিপ্লবী সংস্কারক। তিনিই তার সমাজের অচলায়তন জীর্ণ প্রতিষ্ঠানকে ভেঙে নতুন করে গড়ে তোলেন। লুপ্ত নারী মর্যাদাকে উদ্ধার করে তিনি নারীকে পুরুষের সমান অধিকার দান করেন। নারীর শাশ্বত মাতৃত্বের পবিত্রতা ও গৌরব তিনিই প্রথম প্রচার করেন। ঘোষণা করেন, জননীর পদতলে সন্তানের মুক্তি।

৮। মহানবীর ওফাত :

 আমাদের প্রাণপ্রিয় নবী দো-জাহানের সর্দার হজরত মুহম্মদ (স) ৬৩ বছর বয়সে একাদশ হিজরীর ১২ রবিউল আউয়াল (৬৩২ খ্রিস্টাব্দের ৮ জুন) সোমবার দ্বিপ্রহরে নামাজরত অবস্থায় ইহজগতের মানুষকে শোকসাগরে ভাসিয়ে জান্নাতবাসী হন।

উপসংহার :

 বিশ্বনবী, মহাসাধক, মহাজ্ঞানী হজরত মুহম্মদ (স) ছিলেন একাধারে সমাজসেবক, সংস্কারক, ন্যায়বিচারক, ধর্মপ্রবর্তক ও সাম্রাজ্য স্থাপক। আরবের শতধা বিভক্ত, যুদ্ধরত বর্বর গোত্রগুলোকে সংঘবদ্ধ করে এক জাতি, এক রাষ্ট্র ও সর্বকালের উপযোগী এক পবিত্র অলঙ্ঘনীয় বিধান প্রতিষ্ঠা করে তিনি মানব সমাজকে নব জীবন দান করেন। শুধু মুসলমানদের দৃষ্টিতেই নয়, আলফ্রেড দ্য লামার্টিন, জন উইলিয়ম ড্রেপার, জর্জ বার্নার্ড শ প্রমুখ অসংখ্য অমুসলিম মনীষী কর্তৃকও হজরত মুহম্মদ (স) সর্বশ্রেষ্ট মহামানব ও প্রথিবীর সর্বাপেক্ষা সফলকাম ব্যক্তিত্ব হিসেবে আখ্যায়িত হয়েছিলেন।

02. ১০০০ শব্দ

মহানবী (সা.)–এর জীবনী রচনার হাজার বছর

জীবনীগ্রন্থের দুটি বাহু: মহানবী (সা.)–এর জীবনী আলোচনার প্রধানতম দুটি বাহু রয়েছে। একটি হলো ‘সিরাত’; যাকে ‘সিয়ার’ ও ‘মাগাজি’ও বলা হয়। সিরাত মানে জীবনী। আমরা মহানবী (সা.)–এর জীবনীর যে সাধারণ ধরনটি দেখি, অর্থাৎ জন্ম থেকে তাঁর জীবনের ধারাবাহিক ঘটনাবলির বিবরণ সেটিই ‘সিরাত’ নামে পরিচিত এবং এ-জাতীয় গ্রন্থকে সাধারণত সিরাতগ্রন্থ বলা হয়। তবে আরেকটা দিক আছে—নবীজির দৈহিক গঠন, আচরণ ও কার্যক্রমের বর্ণনা। একে বলে ‘শামায়েল’। শামায়েল রচনার ধারাটা শুরু হয় একটু পরে। শামায়েল গ্রন্থকারকগণ প্রথম দিকে কেবল নবীজির দৈহিক বৈশিষ্ট্য আলোচনা করার মধ্য দিয়ে তাঁর অবয়ব-প্রকৃতি তুলে ধরার চেষ্টা করতেন। পরবর্তী সময়ে আরও বিস্তৃতি আকারে নবীজির আচার-আচরণ, ইবাদত-বন্দেগি, বিনয়-কোমলতা—এভাবে তাঁর ব্যক্তিজীবনের সব দিক উল্লেখ করা হতে থাকে। শামায়েলবিষয়ক বিখ্যাত গ্রন্থগুলো হলো ইমাম তিরমিজির (মৃ. ২৭৯ হি.) ‘শামায়েল তিরিমিজি’, ইমাম বাগাবির (মৃ. ৫১৬ হি.) ‘আল আনওয়ার ফিশ শামায়েল’, ইবনে কাসিরের (মৃ. ৭৭৪ হি.) ‘আল-ফুসুল ফি সিরাতির রসুল’ ও জালালুদ্দিন সুয়ুতির (মৃ. ৭৭৪ হি.) ‘শামায়িলুশ শারিফা’ এবং বর্তমান সময়ে সিরিয়ান লেখক সালেহ আহমাদ শামির (জন্ম ১৯৩৪) ‘মিন মায়িনিশ শামায়েল’, যা ইতিমধ্যে আকিক পাবলিকেশনস, ঢাকা থেকে ‘মুহাম্মাদ স.: ব্যক্তি ও নবী’ নামে অনুবাদিত হয়ে প্রকাশ পেয়েছে।
প্রথম যুগের রচনাবলি: প্রথম মহানবী (সা.)–এর জীবনী রচনা করেন কে—এই সময়ে এসে তাঁর নিশ্চিত সন্ধান পাওয়া দুরূহ। ১০৯২ সালে সৌদি আরবের কিং সাউদ ইউনিভার্সিটি থেকে প্রকাশিত ‘আসসিরাতুন নাবাবিয়াহ ফি যাওইল মাসাদিরিল আসলিয়া’ এ-বিষয়ক একটি প্রামাণ্যগ্রন্থ। ড. মাহদি রিজকুল্লাহ আহমাদ তাতে চোদ্দ শতকের মিসরীয় স্কলার ইবনে হাজার আসকালানির অভিমতকে প্রাধান্য দিয়ে প্রথম তিনজন রচয়িতার নাম ও রচনার উল্লেখ করেছেন।

এক. সাহল ইবনে হাসমা (রা.)। তাঁর জন্ম তৃতীয় হিজরিতে। কৈশরে তিনি মহানবী (সা.)–কে দেখেছেন এবং উমাইয়া খলিফা মুয়াবিয়ার আমলে (৪১-৬০ হি.) মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর সেই জীবনীর বিভিন্ন অংশ মৌলিক সূত্র আকারে নবম শতকের ঐতিহাসিক বালাজুরি রচিত ‘আনসাব’, ইবনে সাদ রচিত ‘তাবাকাত’, তাবারি রচিত ‘তারিখে তাবারি’ এবং ওয়াকিদির বিভিন্ন রচনায় পাওয়া যায়।

গত শতকের প্রথম দিকে জার্মান প্রাচ্যবিদ এডওয়ার্ড সাচাউ (মৃ. ১৯৩০ খ্রি.) বার্লিনে সরকারি প্রত্নতাত্ত্বিক সংগ্রহশালা থেকে চতুর্দশ শতাব্দীর শেষের দিকের হাদিসবেত্তা ইউসুফ ইবনে কাজি শাহবাহ (মৃ. ১৩৮৭ খ্রি.) সংকলিত মুসা ইবনে উকবা বর্ণিত হাদিসগুলো ও ‘মাগাজি’র ২০টি অধ্যায়–সংবলিত একটি পাণ্ডুলিপি আবিষ্কার করেন এবং কিছু নির্বাচিত অংশ ইংরেজিতে প্রকাশ করেন। এর মধ্য দিয়ে আধুনিক সময়ে প্রথমবারের মতো গ্রন্থটি আলোর মুখ দেখে।

দুই. সাইদ ইবনে সাদ ইবনে উবাদা খাজরাজি। তাঁর রচনা ইবনে হাম্বল ও আবি-ইওয়ানার ‘মুসনাদ’ এবং তাবারির ‘তারিখে তাবারি’তে রয়েছে।

তিন. আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (মৃ. ৭৮ হিজরি)। খ্যাতিমান তাফসিরবিশারদ সাহাবি। হাদিস ও সিরাতের বিভিন্ন গ্রন্থে তাঁর রচনা পাওয়া যায়। তাঁদের তিনজনের রচিত নবীজীবনী পুস্তকাকারে পাওয়া যায় না এবং পরবর্তী সময়েও সেই রচনাবলি কোথাও একত্রে সংকলিত হয়নি।

তাঁদের পরে রচনাকর্মে হাত দেন উরওয়া ইবনে জুবাইর (রা.) (মৃ. ৯২ হি.), সাদ ইবনে মুসাইয়িব মাখজুমি (মৃ. ৯৪ হি.), আবদুল্লাহ ইবনে কাব ইবনে মালেক (মৃ. ৯৭ হি.) ও খলিফা উসমানের (রা.) ছেলে আবান ইবনে উসমান (মৃ.১০৫ হি.), ওয়াহাব ইবনে মুনাববিহ (মৃ. ১১০ হি.), ইবনে শিহাব জুহরি (মৃ. ১২০ হি.), শুরাহবিল ইবনে সাদ (মৃ. ১২৩ হি.) ও আবদুল্লাহ ইবনে আবু বাকর ইবনে হাজাম (মৃ. ১৩৫ হি.)। কিন্তু উরওয়া, ওহাব ও জুহরির রচনা ছাড়া সব কটি নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে, কিছু কিছু অংশমাত্র বিক্ষিপ্তভাবে বিভিন্ন ইতিহাসগ্রন্থে টিকে আছে।

উরওয়া ইবনে জুবাইর (রা.) ছিলেন সাহাবি আবু বকরের (রা.) বড় মেয়ে আসমার ছেলে। তিনি উমাইয়া খলিফা আবদুল মালেক ইবনে মারওয়ান ও আল ওয়ালিদের সময়ে নবীযুগে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন ঘটনা নিয়ে জানতে চাওয়া চিঠির জবাব লিখতেন। তাঁকে বহু ঐতিহাসিক গ্রন্থে মুহাম্মদ (সা.)–এর ‘প্রথম জীবনীকার’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। ভারতের খ্যাতিমান স্কলার ড. মুহাম্মাদ মুস্তফা আজমি (মৃ. ২০১৭ খ্রি.) তাঁর রচিত পুস্তিকাটির কেবল শেষভাগটি উদ্ধার করতে সক্ষম হন—যা আবুল আসওয়াদ মিসরির বর্ণনায় পাওয়া যায় এবং ‘মাগাজি রসুলিল্লাহ স. লি-উরওয়াহ ইবনি জুবাইর বি-রিওয়াতি আবিল আসওয়াদ’ শিরোনামে রিয়াদ (সৌদি আরব) থেকে ১৯৮১ সালে প্রকাশ করেন। ওয়াহাব ইবনে মুনাববিহর রচনার একটি অংশ বর্তমানে জার্মানির হাইডেলবার্গে সংরক্ষিত আছে বলে জানা যায়। আর ইবনে শিহাব জুহরির রচনা বিভিন্ন ইতিহাসগ্রন্থ থেকে কুড়িয়ে এনে ২ হাজার পৃষ্ঠার পাণ্ডুলিপি তৈরি করেন মদিনা ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. মুহাম্মাদ বিন মুহাম্মাদ আওয়াজি এবং তা দুই খণ্ডে ‘মারাউইয়্যাত আল ইমাম জুহরি ফিল মাগাজি’ শিরোনামে ২০০৪ সালে মদিনা থেকে প্রকাশিত হয়।

সর্বপ্রাচীন পূর্ণাঙ্গ জীবনীগ্রন্থ: প্রাচীন সিরাত গ্রন্থের কথা উঠলেই সবাই একনামে ইবনে ইসহাক (মৃ. ১৫১ হি.) রচিত ‘সিরাতে ইবনে ইসহাক’কে চেনেন; যার ভিত্তিতে আবদুল মালিক ইবনে হিশাম (মৃ. ২১৮ হি.) জনপ্রিয় সিরাতগ্রন্থ ‘সিরাতে ইবনে হিশাম’ রচনা করেছেন। অথচ এর অন্তত এক যুগ আগে রচিত হয়েছে মুসা ইবনে উকবার (মৃ. ১৪১ হি.) সুবিশাল সিরাতগ্রন্থ ‘আল-মাগাজি’ এবং তা এখনো অক্ষত আছে। একটি বর্ণনা অনুযায়ী ‘মুআম্মার ইবনে রাশেদ’র (মৃ. ১৫১ হি.) সিরাতগ্রন্থ ‘আল-মাগাজি’ও সিরাতে ইবনে ইসহাকের পূর্বে রচিত এবং তার কপিও দুর্লভ নয়। লেখকদের জীবনকালের তারতম্য থেকেও প্রাচীনত্বের বিষয়টি পরিষ্কার হয়। ইবনে ইসহাকের জন্ম ৮৫ হিজরি এবং মৃত্যু ১৫১ হিজরি। আর মুসা ইবনে উকবার জন্ম ৬৮ হিজরি এবং মৃত্যু ১৪১ হিজরি। সুতরাং অস্তিত্বের বিচারে ইবনে ইসহাক রচিত ‘সিরাত’ নয়—মুসা ইবনে উকবার ‘আল-মাগাজি’ সর্বপ্রাচীন পূর্ণাঙ্গ সিরাতগ্রন্থ।

Neuromedicine Specialist Doctor in Rajshahi | নিউরো মেডিসিন বিশেষজ্ঞ রাজশাহী
গত শতকের প্রথম দিকে জার্মান প্রাচ্যবিদ এডওয়ার্ড সাচাউ (মৃ. ১৯৩০ খ্রি.) বার্লিনে সরকারি প্রত্নতাত্ত্বিক সংগ্রহশালা থেকে চতুর্দশ শতাব্দীর শেষের দিকের হাদিসবেত্তা ইউসুফ ইবনে কাজি শাহবাহ (মৃ. ১৩৮৭ খ্রি.) সংকলিত মুসা ইবনে উকবা বর্ণিত হাদিসগুলো ও ‘মাগাজি’র ২০টি অধ্যায়–সংবলিত একটি পাণ্ডুলিপি আবিষ্কার করেন এবং কিছু নির্বাচিত অংশ ইংরেজিতে প্রকাশ করেন। এর মধ্য দিয়ে আধুনিক সময়ে প্রথমবারের মতো গ্রন্থটি আলোর মুখ দেখে। এরপর মরক্কোর ইবনে জুহর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. আবু মালিক মুহাম্মাদ ইবনুল হুসাইন বাকিশিশ দীর্ঘদিন পরিশ্রম করে বিভিন্ন প্রাচীন পাণ্ডুলিপি ঘেঁটে আরবি মূলপাঠ উদ্ধারে সক্ষম হন, এরপর প্রয়োজনীয় টিকা-ভাষ্য যুক্ত করেন এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের মানবিক অনুষদ থেকে ১৯৯৪ সালে মুদ্রণের ব্যবস্থা করেন।

আধুনিক যুগে আরবি ভাষার অন্যতম সিরাতগ্রন্থ হলো নাসিরুদ্দিন আলবানি (মৃ. ১৯৯৯ ইং) রচিত ‘সহিহ আস-সিরাতুন নাবাবিয়্যা’, ভারতের বিখ্যাত দায়ি আবুল হাসান আলী নদভি (মৃ. ২০০০ ইং) রচিত ‘আস-সিরাতুন নাবাবিয়্যা’; যা বহু ভাষায় অনূদিত হয়েছে, বাংলা ভাষায় এর অনুবাদ ‘নবীয়ে রহমত’ শিরোনামে প্রকাশিত হয়েছে।

পরবর্তী যুগের শ্রেষ্ঠ রচনা: হিজরি প্রথম ও দ্বিতীয় শতক ছিল নবীজীবনী রচনার প্রথম যুগ। তৃতীয় শতক থেকে দ্বিতীয় যুগের সূচনা হয়। এই যুগই হলো নবীজীবনী রচনার স্বর্ণযুগ এবং ইতিহাসের ধুলোর আস্তর কঠিন হওয়ার আগেই ইসলামের ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ পণ্ডিতগণ বিরাট বিরাট কলেবরের জীবনী ও ইতিহাসগ্রন্থ রচনা করেছেন। তৃতীয় শতকের শ্রেষ্ঠ রচনা হলো ‘সিরাতে ইবনে হিশাম’, যার কথা পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে। ১৯৯৬ সালে ব্রিটিশ প্রাচ্যবিদ আলফ্রেড গিলিয়াম অনূদিত ইংরেজি সংস্করণ অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে প্রকাশিত হলে তা আধুনিক সময় জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। বাংলা ভাষায়ও এর বেশ কয়েকটি অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছে। এরপরই রয়েছে প্রসিদ্ধ ঐতিহাসিক মুহাম্মাদ ইবনে ওমর আল-ওয়াকিদির (মৃ. ৩৪৬ হি.) ‘আত-তারিখ ওয়াল মাগাজি’ গ্রন্থটি। লেখক ‘ওয়াকিদি’ নামেই সমধিক পরিচিত, তিনি মদিনায় জন্মগ্রহণ করেন। তবে তাঁর এই গ্রন্থটির বিভিন্ন বর্ণনার ব্যাপারে ইসলামবেত্তা পণ্ডিতগণ বেশ ‘আপত্তি’ তুলেছেন। চতুর্থ হিজরি শতকে রচিত হয় ঐতিহাসিক জারির ইবনে তাবারির ( মৃ. ৩১০ হি.) ‘আত-তারিখ ওয়াল উমাম’ এবং আলী ইবনে হুসাইন মাসউদির (মৃ. ৩৪৬ হি.) ‘মুরুজু আজ-জাহাব’, পঞ্চম হিজরি শতকে ইবনে হাজমের (মৃ. ৪৫৬ হি.) ‘জাওয়ামিউস সিরাহ’, ষষ্ঠ শতকে আবদুর রহমান সুহাইলি আন্দালুসির (মৃ. ৫৮১ হি.) ‘রওজুল উনফ’, সপ্তম শতকে প্রকাশিত হয় ইমাম নববির (মৃ. ৬৭৬ হি.) ‘তাহজিবুস সিরাহ আন-নাবাবিয়্যাহ’, অষ্টম শতকে তিনটি গ্রন্থ বিখ্যাত হয়—ইমাম জাহাবির (মৃ. ৭৪৮ হি.) ‘আল-মাগাজি’, ইবনুল কাইয়্যিম জাওজির (মৃ. ৭৫১ হি.) ‘জাদুল মাআদ’ ও ইবনে কাসিরের (মৃ. ৭৭৪ হি.) ‘আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া’। এর মধ্যে ‘জাদুল মাআদ’ গ্রন্থটি ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ থেকে ৬ খণ্ডে বাংলা অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছে। নবম হিজরি শতকের দুটি বিখ্যাত সিরাতগ্রন্থ হলো ঐতিহাসিক আহমদ ইবনে আলী মাকরিজির (মৃ. ৮৪৫ হি.) ‘ইমতাউল আসমা বিমা লিররসুলি মিনার আবনা’ ও প্রখ্যাত হাদিসবেত্তা ইবনে হাজার আসকালানির (মৃ. ৮৫২ হি.) ‘মুখতাসারুস সিয়ার’; দশম শতকে শিহাবুদ্দিন কাসতালানি (মৃ. ৯২৩ হি.) লেখেন ‘আল-মাওয়াহিবুল লাদুনিয়্যা’, এগারো শতকে রচিত হয় আল্লামা বুরহানুদ্দিন হালাবির (মৃ. ১০৪৪ হি.) বিখ্যাত সিরাতগ্রন্থ ‘ইনসানুল উয়ুন ফি সিরাতিল আমিনিল মামুন’, যা ‘সিরাতে হালাবিয়া’ নামে সমধিক পরিচিত।

এ যুগের রচনার সিংহভাগ রচিত হয়েছে আরবি ভাষায়, যদিও লেখকদের সবাই আরব ছিলেন, তা নয়। কিন্তু মুসলিম বিশ্বের লেখা ও শেখার মাধ্যম আরবি হওয়ায় রচয়িতাগণ আরবি ভাষাকেই প্রাধান্য দিয়েছেন।

আধুনিক যুগের বিচিত্র রচনা: ইসলামের ইতিহাসের এমন কোনো পণ্ডিত খুঁজে পাওয়া ভার, যিনি নবীজীবনের ওপরে কলম ধরেননি। কারও কারও রচনা কলেবরে এতটাই বিরাট আকার ধারণ করেছে যে তা কয়েক হাজার পৃষ্ঠা ছাড়িয়ে গেছে। বিভিন্ন দেশে ‘সিরাত বিশ্বকোষ’ রচিত হয়েছে। আবার কেউ কেউ নবীজীবনের ওপর আরবি ভাষায় বিরাট কাব্যগ্রন্থ রচনা করেছেন। মহানবী (সা.)–এর জীবদ্দশাতেও তাঁকে নিয়ে অনেক প্রশস্তিমূলক কাব্য রচিত হয়েছে বটে, তবে তা জীবনী আকারে ছিল না। ১২ হিজরি শতকে মাসউদ ইবনে মুহাম্মাহ আল-ফাসি (মৃ. ১১১৯ হি.) প্রথম কাব্যজীবনী রচনা করেন। গ্রন্থের নাম দেন ‘নাফাইসুদ দুরার ফি আখবারি সাইয়িদিল বাশার’। এরপর একইভাবে আহমদ বুখারি দিময়াতি (মৃ. ১৮৯২ ইং) রচিত ‘সাআদাতুত দারাইন’ এবং ইউসুফ ইসমাইল নাবহানি (মৃ. ১৯৩২ ইং) লেখেন ‘আন-নাজমুল বাদি ফি মাওলিদিশি শাফি’। বাংলা ভাষায় কবি কাজী নজরুল ইসলাম ‘মরুভাস্কর’ লিখেছেন। গ্রন্থটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৫১ খ্রিষ্টাব্দে। মহানবী (সা.)–এর জীবনী নিয়ে চারটি পর্বে ১৮টি খণ্ড-কবিতা নিয়ে রচিত হয়েছে এই কাব্যগ্রন্থ।

আধুনিক যুগে আরবি ভাষার অন্যতম সিরাতগ্রন্থ হলো নাসিরুদ্দিন আলবানি (মৃ. ১৯৯৯ ইং) রচিত ‘সহিহ আস-সিরাতুন নাবাবিয়্যা’, ভারতের বিখ্যাত দায়ি আবুল হাসান আলী নদভি (মৃ. ২০০০ ইং) রচিত ‘আস-সিরাতুন নাবাবিয়্যা’; যা বহু ভাষায় অনূদিত হয়েছে, বাংলা ভাষায় এর অনুবাদ ‘নবীয়ে রহমত’ শিরোনামে প্রকাশিত হয়েছে। সফিউর রহমান মোবারকপুরির (মৃ. ২০০৬ ইং) ‘আর রাহীকুল মাখতুম’ আরবি বইটি ১৯৭৯ সালে রাবেতায়ে আলাম আল ইসলামি আয়োজিত প্রথম উন্মুক্ত সিরাত গ্রন্থ প্রতিযোগিতায় ১১৮৭টি পাণ্ডুলিপির মধ্যে প্রথম স্থান অধিকার করে। এটিকে সিরাতসংক্রান্ত বিশাল সংগ্রহশালার একটি নির্যাসগ্রন্থ বলা যায়। মিসরীয় চিন্তাবিদ মুহাম্মাদ আল গাজালি (মৃ. ১৯৯৬ ইং) রচনা করেন সিরাতবিষয়ক একটি বিশ্লেষণগ্রন্থ ‘ফিকহুস সিরাহ’। একই নামে সিরিয়ান শায়খ রামাদান আল-বুতিরও (মৃ. ১৯৯৬ ইং) একটি রচনা রয়েছে। এ ছাড়া আরবি ভাষায় লিখিত সিরাতের মধ্যে সাইয়েদ সোলাইমান নদভির ‘আস-সিরাতুন নাবাবিয়া’, শায়খ সালেহ আল মুনাজ্জিদ ‘খুলুকুন আজিম’ ও আলী সাল্লাবির ‘আসসিরাতুন নাবাবিয়া আরজু ওয়াকায়ি ওয়া তাহলিলিল আহদাস’ উল্লেখযোগ্য।

উর্দু ভাষায় অমুসলিমদের রচনাবলির মধ্যে বিখ্যাত দুটি গ্রন্থ হলো ইন্ডিয়া পত্রিকার সম্পাদক গুরু দত্ত সিং দারা (G S Dara) লিখিত ‘রসুলে আরাবি’, যা আবু তাহের মেছবাহ কর্তৃক ‘তোমাকে ভালোবাসি হে নবী’ শিরোনামে বাংলা ভাষায় অনূদিত হয়ে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে।

উর্দু ভাষায় রয়েছে ভারতের শিক্ষাবিদ মাওলানা আবুল কালাম আজাদের ‘রসুলে রহমত’ ও শিবলী নুমানির ‘সিরাতুন নাবী’। ইংরেজি ভাষার আলোচিত সিরাতগ্রন্থগুলো মধ্যে মার্টিন লিংগসের ‘Muhammad: His Life Based on the Earliest Sources’, জামাল বাদাবির ‘Muhammad A Blessing For Mankind’, ওয়াহিদুদ্দিন খানের ‘Prophet of Revolution’, হোসাইন হায়কলের ‘Muhammad Rasulallah’, মোহাম্মদ হামিদুল্লাহর ‘Muhammad Rasulullah: A concise survey of the life and work of the founder of Islam’, সাইয়েদ হোসাইন নাসেরের ‘Muhammad, Man of God’, আদিল সালাহির ‘Muhammad: man and prophet, a complete study of the life of the Prophet of Islam’, ফেতুল্লাহ গুলেনের ‘The Messenger of God: Muhammad’ ও তারিক রামাদানের ‘The Messenger: the Meanings of the Life of Muhammad’ উল্লেখযোগ্য।

অমুসলিমদের রচনাবলি: ঊনবিংশ শতকের শুরুতে প্রাচ্যবিদদের রচনায় বেশ কিছু জীবনীগ্রন্থের নাম উঠে আসে। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তাতে মহানবী (সা.)–কে উপস্থাপন করার চেয়ে তাঁকে আক্রমণ করা হয়েছে বেশি। ফিলিপ কে হিট্টি আরবি ভাষা ও সাহিত্যের একজন প্রখ্যাত পণ্ডিত। তাঁর রচিত ‘ইসলাম অ্যান্ড দ্য ওয়েস্ট’ গ্রন্থের চতুর্থ অধ্যায়ের শিরোনাম দিয়েছেন ‘ইসলাম ইন ওয়েস্টার্ন লিটারেচার’। তিনি দেখিয়েছেন, ১৬৪৯ সালে সিউর ডিউ রায়ার কোরআনের ফারসি তরজমা প্রকাশ করেন। তার সঙ্গে মহানবী (সা.)–এর সংক্ষিপ্ত জীবনালেখ্য যুক্ত করে Alcoran of Mahomet নামে প্রকাশ করেন। এই Mahomet হলো মুহাম্মদ (সা.)–এর বিকৃত রূপ। অক্সফোর্ড ডিকশনারিতে একই নামের ৪১টি রূপের সন্ধান পাওয়া যায়। এরপর ১৭৩৬ সালে ভলতেয়ার ‘মাহোমেত’ নামে একটি পাঁচ অঙ্কের প্রহসন রচনা করেন; যার পুরো শিরোনাম: Le fanatisme, ou Mahomet le Prophete (ধর্মান্ধতা বা মাহোমেত নবী)। নাটকের মাহোমেত [মুহাম্মদ (সা.)] চরিত্রটি ধর্মান্ধ, যে তাঁর সমালোচকদের হত্যার আদেশ দেয় এবং ‘পালমিরা’ নামে এক মেয়ের প্রেমে মত্ত হয়। ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়ন বোনাপার্ট সেন্ট হেলেনাতে বন্দী থাকাকালে এই নাটকের কঠোর সমালোচনা করেন। ভলতেয়ার তাঁর বক্তব্য পরিবর্তন করেন এবং বলেন, ‘তিনি [মুহাম্মদ (সা.)] অবশ্যই খুব মহান ব্যক্তি ছিলেন এবং তিনি মহান মানুষদের প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন। ছিলেন বিজয়ী বিধানদাতা, প্রজ্ঞাবান ও নেতা। সাধারণ মানুষের চোখে তিনি পৃথিবীতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করেছেন।’

১৮৩০ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশের একজন পূর্বপুরুষ রেভারেন্ড জর্জ বুশ এ এম (১৭৯৬-১৮৫৯) লেখেন ‘The Life of Mohammed : Founder of the Religion of Islam and of the Empire of the Saracens’। কিসিঞ্জার লিগেছি রিপ্রিন্ট ১৮৩৩ সালে তা পুনঃপ্রকাশ করে এবং নতুন করে ২০০২ সালে লন্ডনে আবার ছাপা হয়। ১৮৪৩ সালে জার্মান প্রাচ্যবিদ গুস্তাফ ওয়েইল লেখেন ‘Mohammed der Prophet, sein Leben und seine Lehre’, ১৮৫১ সালে অস্ট্রিয়ান প্রাচ্যবিদ স্প্রেঙ্গার লেখেন ‘Aloys Sprenger, The Life of Mohammad, from Original Sources’, ১৮৫৮ সালে স্কটিশ লেখক উইলিয়াম মুর ৪ খণ্ডে লিখেছেন ‘The Life of Muhammad and History of Islam to the Era of the Hegira’। তবে ১৯৪৭ সালে আর ভি সি বোদলে লিখিত বিখ্যাত ‘The Messenger: the Life of Mohammed’ গ্রন্থটি বেশ প্রশংসা অর্জন করে, খ্যাতিমান স্কলার আলী নদভিসহ পরবর্তীকালের সিরাত গ্রন্থকারগণ এই গ্রন্থের রেফারেন্স ব্যবহার করেন। এমন নির্ভরযোগ্য গ্রন্থ হলো উইলিয়াম মন্টোগোমেরি ওয়াট রচিত Muhammad at Mecca ও Muhammad at Medina.

উর্দু ভাষায় অমুসলিমদের রচনাবলির মধ্যে বিখ্যাত দুটি গ্রন্থ হলো ইন্ডিয়া পত্রিকার সম্পাদক গুরু দত্ত সিং দারা (G S Dara) লিখিত ‘রসুলে আরাবি’, যা আবু তাহের মেছবাহ কর্তৃক ‘তোমাকে ভালোবাসি হে নবী’ শিরোনামে বাংলা ভাষায় অনূদিত হয়ে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। আরেকটি হলো স্বামী লক্ষ্মণ প্রসাদ লিখিত ‘আরব কা চান্দ’। গ্রন্থটির ভূমিকায় লেখকের পরিচয়ে বলা হয়েছে, লেখক একজন হিন্দু সাহিত্যানুরাগী যুবক; সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদের বাইরে এসে সত্যপ্রিয়তায় প্রাণিত হয়ে শেষ নবীর জীবনী লিখেছেন। ভারতের হরিয়ানা রাজ্যের ফতেহাবাদ জেলার তোহানায় থাকতেন তিনি। ১৯৩৯ সালে ২৬ বছর বয়সে মারা যান। গ্রন্থটি পরে পাকিস্তানের লাহোর থেকে প্রকাশিত হয়।

বাংলা ভাষায় লেখা নবীজীবনী: বাংলা ভাষায় যাঁরা মহানবী (সা.)–এর জীবনীগ্রন্থ লেখেন, তাঁদের বেশ কয়েকজনই ইসলামের অনুসারী নন, তবু ভক্তি ও ভালোবাসার অর্ঘ্য নিবেদনে তাঁরা মুসলিমদের চেয়ে পিছিয়ে ছিলেন না। যদিও ১৮০২ সালে শ্রীরামপুর মিশন প্রেস থেকে জনৈক লেখকের ‘মহম্মদের বিবরণ’ শিরোনামের একটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়, কিন্তু তা ছিল কুৎসায় ভরপুর। তবে বাংলায় প্রথম যাঁর পূর্ণাঙ্গ ও নির্ভরযোগ্য গ্রন্থ সামনে আসে, তিনি হলেন রেভারেন্ড জেমস লং। তিনি প্রথম জীবনে ছিলেন একজন খ্রিষ্টান, পরে মুসলিম হন। ১৮৮৫ সালে তা কলকাতার সত্যার্ণব প্রকাশনী থেকে ‘মুহাম্মদের জীবনচরিত্র’ নামে প্রকাশিত হয়। একই বছর অতুল কৃষ্ণমিত্র লেখেন ‘ধর্মবীর মুহাম্মদ’ নামে একটি নাট্যজীবনী। ১৮৮৬ সালে কৃষ্ণ কুমার মিত্রের ‘মুহাম্মদ চরিত্র ও মুসলমান ধর্মের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস’ প্রকাশিত হয় শ্যামা প্রেস, কলকাতা থেকে এবং গিরিশ চন্দ্র সেন লেখেন ৩ খণ্ডে ‘মহাপুরুষ মুহাম্মদের জীবনচরিত’। এরপর ১৯০৪ সালে রামপ্রাণ গুপ্ত লিখেছেন ‘হজরত মুহাম্মদ ও হজরত আবু বকর’।

১৯৪২ সালে দ্য শিকাগো ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে প্রকাশিত হয় ‘Aishah: the beloved of Mohammed’। এই গ্রন্থের লেখক নাবিয়া অ্যাবট ছিলেন আমেরিকার একজন প্যাপিওরোলজিস্ট ও পুস্তিকাবিদ। তিনি শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের ওরিয়েন্টাল ইনস্টিটিউটে প্রথম মহিলা অধ্যাপক নির্বাচিত হন। আরবি লিপি ও ইসলামের প্রাচীনতম লিখিত দলিলগুলোর উত্থানের বিষয়ে তাঁর গবেষণার জন্য বিশ্বব্যাপী স্বীকৃতি অর্জন করেছিলেন।

বাংলা সাহিত্যে নবীজিকে নিয়ে মুসলিমদের মধ্যে প্রথম গ্রন্থ রচনা করেন শেখ আবদুর রহীম (১৮৫৯-১৯৩১)। গ্রন্থটির নাম ‘হযরত মুহম্মদের স. জীবনচরিত ও ধর্মনীতি’, ১৮৮৭ সালে ৪০৪ পৃষ্ঠার গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়। পরবর্তী সময়ে প্রকাশিত শ্রেষ্ঠ সিরাতগ্রন্থ হলো কলকাতা থেকে ১৯০৮ সালে ডা. সৈয়দ আবুল হোসেন রচিত ‘মোসলেম পতাকা’, ১৯১৫ সালে কলকাতা থেকে শেখ মোহাম্মদ জমীর উদ্দীন রচিত ‘মাসুম মোস্তফা (সা.)’, ১৯২২ সালে কলকাতা থেকে এয়াকুব আলী চৌধুরী রচিত ‘মানব মুকুট’, ১৯২৫ সালে মোবিনুদ্দীন আহমদ জাহাঙ্গীর নগরী রচিত ‘নবীশ্রেষ্ঠ’, ১৯২৫ সালে কলকাতা থেকে মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলী রচিত ‘মরু ভাস্কর’, ১৯৪২ সালে চুঁচুড়া থেকে কবি গোলাম মোস্তফা রচিত ‘বিশ্বনবী’, ১৯৪৯ সালে ঢাকা থেকে খান বাহাদুর আবদুর রহমান খাঁ রচিত ‘শেষ নবী’, ১৯৫১ সালে ঢাকা থেকে মাওলানা আবদুল খালেক রচিত দুই খণ্ডের ‘ছাইয়েদুল মুরছালীন’, ঢাকা থেকে ১৯৬০ সালে মুহাম্মদ বরকতুল্লাহ রচিত ‘নবী গৃহ সংবাদ’, ১৯৬৮ সালে শায়খুল হাদিস মাওলানা মুহাম্মদ তফাজ্জল হোসাইন রচিত ‘হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা (সা.) সমকালীন পরিবেশ ও জীবন’। এ ছাড়া কবি আল মাহমুদ রচিত ‘মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)’, কবি মুহাম্মদ নূরুল হুদা রচিত ‘মহানবী’ ও ২০০২ সালে প্রকাশিত কবি আবদুল মান্নান সৈয়দ রচিত ‘বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)’ অনন্য জীবনীগ্রন্থ হিসেবে স্বীকৃত। ইসলামিক ফাউন্ডেশনের গবেষক নাসির হেলাল তাঁর গবেষণায় মধ্যযুগ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত বাংলায় রচিত মোট ১০২৮টি গ্রন্থের নাম উল্লেখ করেছেন।

নারীদের সিরাত রচনা: মহানবী (সা.)–এর জীবনীগ্রন্থ রচনার কাজটি ইতিহাসের সূচনালগ্ন থেকে পুরুষদের হাতেই পরিপুষ্ট হয়েছে। তবে আধুনিক সময়ে বেশ কয়েকজন নারীর লিখিত গ্রন্থ বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে। এ ক্ষেত্রে সবার ওপরে থাকবেন ক্যারেন আর্মস্ট্রং। তিনি ইংল্যান্ডের ওয়ারসেস্টারশায়ারের উইল্ডমুরে জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৯৬২ থেকে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত ছিলেন গির্জার নান। ১৯৯১ সালে তাঁর ‘Muhammad: A Biography of the Prophet’ গ্রন্থটি প্রকাশিত হলে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে এবং বাংলা ভাষাসহ বিশ্বের বহু ভাষায় অনূদিত হয়। এই গ্রন্থে তিনি মুহাম্মদ (সা.)–এর জীবনের যেসব ঘটনা নিয়ে পশ্চিমাদের সমালোচনা ছিল, সেগুলোর যৌক্তিকতা প্রমাণ করতে তাদের সমাজের উপমা উল্লেখ করেন। ২০০৬ সালে ‘Muhammad: A Prophet For Our Time’ নামে আরও একটি ননফিকশন গ্রন্থ প্রকাশ করেন।

তবে এর আগে ১৯৪২ সালে দ্য শিকাগো ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে প্রকাশিত হয় ‘Aishah: the beloved of Mohammed’। এই গ্রন্থের লেখক নাবিয়া অ্যাবট ছিলেন আমেরিকার একজন প্যাপিওরোলজিস্ট ও পুস্তিকাবিদ। তিনি শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের ওরিয়েন্টাল ইনস্টিটিউটে প্রথম মহিলা অধ্যাপক নির্বাচিত হন। আরবি লিপি ও ইসলামের প্রাচীনতম লিখিত দলিলগুলোর উত্থানের বিষয়ে তাঁর গবেষণার জন্য বিশ্বব্যাপী স্বীকৃতি অর্জন করেছিলেন। মুহাম্মদ (সা.)–এর সহধর্মিণী আয়েশা (রা.)–কে কেন্দ্র করে লেখা হলেও এটি মূলত একটি সিরাতগ্রন্থ, যাতে হিজরতের পূর্ব থেকে আয়েশা (রা.)–এর মৃত্যু পর্যন্ত ইসলামের ইতিহাসও সুনিপুণভাবে চিত্রিত হয়েছে। ১৯৮৫ সালে ইউনিভার্সিটি অব নর্থ ক্যারোলিনা প্রেস থেকে প্রকাশিত হয় প্রভাবশালী জার্মান প্রাচ্যবিদ অ্যানেমারি শিমেলের ৩৬৭ পৃষ্ঠার একটি গ্রন্থ। শিরোনাম ‘And Muhammad Is His Messenger: The Veneration of the Prophet in Islamic Piety’। লেখক দীর্ঘদিন হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ছিলেন। ২০১৩ সালে ব্রিটিশ লেখক লেসলি হাজলেটন (জন্ম ১৯৪৫) রচিত ‘The First Muslim: The Story of Muhammad’ নিউইয়র্ক টাইমস এডিটর্স বাছাইয়ে নির্বাচিত হয় এবং জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ২০১৬ সালে ফরাসি লেখক হেলা ওয়ার্দি মহানবী (সা.)–এর জীবনের শেষের দিনগুলো নিয়ে রচনা করেন ‘Les Derniers Jours De Muhammad’ গ্রন্থটি, যা ইতিমধ্যে ‘মুহাম্মাদ ফি আইয়্যামিল আখিরাহ’ শিরোনামে আরবি ভাষায় অনূদিত হয়েছে।

বাংলা ভাষায় নারী সিরাতগ্রন্থকারদের মধ্যে প্রথমে জায়গা করে নিয়েছেন সারা তাইফুর (জ. ১৮৯৩)। তাঁর লিখিত ‘স্বর্গের জ্যোতি’ গ্রন্থটি ১৯১৬ সালে প্রকাশিত হয়। অবশ্য ১৩৭১ বাংলা সনে বাংলা একাডেমি এর একটি সংস্করণ প্রকাশ করে। তাঁর পুরো নাম হুরায়ুন্নিসা সারা খাতুন। কাব্যিক গদ্যে রচিত এ গ্রন্থের ভাষা সাবলীল।

বাংলা ভাষায় নারী সিরাতগ্রন্থকারদের মধ্যে প্রথমে জায়গা করে নিয়েছেন সারা তাইফুর (জ. ১৮৯৩)। তাঁর লিখিত ‘স্বর্গের জ্যোতি’ গ্রন্থটি ১৯১৬ সালে প্রকাশিত হয়। অবশ্য ১৩৭১ বাংলা সনে বাংলা একাডেমি এর একটি সংস্করণ প্রকাশ করে। তাঁর পুরো নাম হুরায়ুন্নিসা সারা খাতুন। কাব্যিক গদ্যে রচিত এ গ্রন্থের ভাষা সাবলীল। লেখিকা অত্যন্ত দরদ দিয়ে গ্রন্থটি রচনা করেছেন। উল্লেখ্য, এ গ্রন্থ প্রকাশের পর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর চিঠি দিয়ে লেখিকাকে অভিনন্দিত করেছিলেন। এরপর খাদিজা আক্তার রেজায়ি লেখেন ‘তিনি চাঁদের চেয়েও সুন্দর’। তিনি ‘আর-রাহিকুল মাখতুম’র মতো কয়েকটি প্রাচীন ও মৌলিক সিরাতগ্রন্থ অনুবাদের জন্য বিখ্যাত হয়েছেন। ২০০৯ সালে মাসুদা সুলতানা রুমির সিরাতগ্রন্থ ‘আমি বারোমাস তোমায় ভালোবাসি’ প্রকাশিত হয় ঢাকার রিমঝিম প্রকাশনী থেকে। সর্বশেষ ২০১৯ সালে প্রবাসী লেখিকা মাজিদা রিফার ‘মহানবী’ প্রকাশিত হয় রাহবার প্রকাশনী, ঢাকা থেকে। অসাধারণ গদ্যে রচিত তাঁর গ্রন্থটি বাংলা সাহিত্যেরও একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন।

সবিশেষ—হাজার বছর ধরে মহানবীর জীবনী রচনার যে অবিরল ধারা চলেছে, তা নিশ্চয় মহাকাল পর্যন্ত রুদ্ধ হওয়ার নয়। কবি যথার্থ বলেছেন, শব্দশিল্পী সকলকালের সকল দেশের সব ভাষার, আহরণ করে সকল মুক্তা মনের মাধুরী করে উজাড়, অনন্তকাল রচে যায় যদি বাণীর হার, তোমার স্তুতি তবুও হে নবী হবে না শেষ।

*লেখক: ইসলাম ধর্ম বিষয়ের গবেষক

03.

মহানবী সাঃ এর জীবনী রচনা ৫০০ শব্দ || শেষ নবীর জীবনী

হযরত মুহাম্মদ সাঃ এর জন্ম তারিখ

রবিউল আউয়াল মাসের ১২ তারিখ, সোমবার। শুক্লা দ্বাদশীর অপূর্ণ চাঁদ সবেমাত্র অস্ত গিয়েছে। সুবহে সাদিকের সুখ-নূরে পূর্ব  আসমান রাঙা হয়ে উঠেছে। আলো আঁধারের দোল খেয়ে ঘুমন্ত প্রকৃতি  আঁখি মেলেছে।

বৃদ্ধ আব্দুল মুত্তালিব তখন কাবাগৃহে বসে আপন গোত্রের লোকদের সাথে নানা বিষয়ে আলাপ করছিলেন। এমন সময় সংবাদ আসল যে, আমিনা এক পুত্ররত্ন প্রসব করেছেন। হর্ষ  ও বিষাদে আবদুল মুত্তালিবের হৃদয় ভরে গেলো।

সংবাদ পাওয়া মাত্রই তিনি আমিনার গৃহে উপস্থিত হয়ে আব্দুল্লাহ তনয়ের মুখ দর্শন করলেন। কী সুন্দর জ্যোতির্ময় বেহেশতী মুখশ্রী! আব্দুল মুত্তালিবের চোখ জুড়িয়ে গেলো। আকুল আগ্রহে শিশুটিকে কোলে নিয়ে তিনি তৎক্ষণাৎ কাবা প্রাঙ্গণে এসে তার জন্য প্রার্থনা করলেন।

সাতদিন পরে আরবের চিরাচরিত নিয়ম অনুযায়ী আবদুল মুত্তালিব শিশুর আকিকা উৎসব করলেন। মক্কার বিশিষ্ট কোরেশ নেতৃবৃন্দ ও আত্মীয়-স্বজনকে দাওয়াত দেয়া হলো। উৎসব শেষে কোরেশ দলপতিগণ জানতে চাইলেন- শিশুর নাম কী রাখলেন?

“মুহম্মাদ”- কোনো এক অদৃশ্য ইঙ্গিতে আব্দুল মুত্তালিব এই কথা বলে ফেললেন। সকলে শিশুকে আশির্বাদ করে চলে গেলেন।

হযরত মুহাম্মদ সাঃ এর মাতার নাম কি

মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (স.) এর পিতার নাম আব্দুল্লাহ আর মাতার নাম আমিনা। এখানে তাঁর পুরো পরিচয় বর্ণনা করা হলো-

নামঃ মুহাম্মাদ মুস্তফা

উপনামঃ আবুল কাসেম

উপাধিঃ আল আমিন

গোত্রঃ কুরাইশ

বংশঃ হাশেমী

জন্মঃ ১২ রবিউল আউয়াল সোমবার, ৫৭০ খ্রিঃ

জন্মস্থানঃ মক্কা

জন্ম সময়ঃ রাত অতিবাহিত হয়ে প্রত্যুষে

পিতাঃ আব্দুল্লাহ ইবনে আব্দুল মুত্তালিব

মাতাঃ আমিনা বিনতে ওয়াহহাব

দুধ মাতাঃ হালিমা

দাদাঃ আব্দুল মুত্তালিব

নানাঃ ওয়াহহাব বিন আবদে মানাফ

নানিঃ বোররা বিনতে ওমজা

মহানবী সাঃ এর শৈশবকাল রচনা

হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাই সালাম এর জন্মের কয়েক দিন পরেই মরুভূমি হতে বেদুঈন নারীরা শিশু সন্তানের অনুসন্ধানে মক্কা নগরীর উপনীত হলো। তখনকার দিনে আরবে এটাই ছিল প্রচলিত প্রথা। সম্ভ্রান্ত আরব পরিবারে কোনো শিশু জন্ম নিলে তার স্তন্যদান এবং লালন-পালনের ভার ধাত্রীর হাতে ন্যস্ত করা হতো। অবশ্য এজন্য ধাত্রীকে উপযুক্ত পুরস্কার ও বেতন দেয়া হত।

ধাত্রীদের সকলেই মনের মত এক একটা শিশু সন্তান লাভ করে ফিরে গেল। কিন্তু মোহাম্মদ ছাড়া অন্য কোনো শিশু হালিমার ভাগ্যে জুটলোনা। তখন হালিমা স্বামীকে ডেকে বললেন- শূন্য হাতে ফিরে গিয়ে লাভ কি? এই এতিম শিশুটিকেই গ্রহণ করি, কী বল?

স্বামী উত্তর দিলেন- নিশ্চয়ই, মোহাম্মদকে গ্রহণ করো। ইহার মধ্য দিয়ে আমাদের নসিব বুলন্দ হইবে। হালিমা তখন শিশু মোহাম্মদকে গ্রহণ করলেন।

হালিমার এক পুত্র, তিন কন্যা ছিল। পুত্রের নাম আব্দুল্লাহ এবং কন্যার নাম আনিসা,হোজায়ফা এবং শায়েমা। শায়েমার বয়স তখন সাত-আট বছরের মত। শিশু মুহাম্মাকে লালন-পালনের কাজে সে সর্বদা মাকে সাহায্য করতো। মুহাম্মাদকে সে বড় ভালোবাসতো।

শিশু মুহাম্মাদকে নিজ গৃহে আনার পরে হালিমা এক আশ্চর্য পরিবর্তন লক্ষ্য করলেন। তার গৃহপালিত’ পশুগুলি অধিকতর পরিপুষ্ট হয়ে উঠলো এবং অধিক পরিমাণে দুগ্ধদান করতে লাগলো। খেজুর বৃক্ষে প্রচুর পরিমাণে খেজুর ফলতে লাগল। কোন দিক দিয়ে তার আর কোন অভাব অনুভব হল না।

এভাবে দুই বছর কেটে গেল। হালিমা মোহাম্মদকে আমিনার নিকট নিয়ে আসলেন। আমিনা পুত্রের স্বাস্থ্যোজ্জ্বল মধুর মুরতি ও দিব্যকান্তি দেখে মুগ্ধ হলেন। মনে মনে আল্লাহকে ধন্যবাদ দিতে লাগলেন। হালিমার উপরেও তিনি খুব সন্তুষ্ট হলেন।

এই সময় মক্কায় অত্যন্ত সংক্রামক রোগের প্রাদুর্ভাব হলো। এ কারণে আমিনা মুহাম্মদকে আরো কিছুদিন হালিমার তত্ত্বাবধানে রেখে দেওয়া সঙ্গত মনে করলেন। বৃদ্ধ মুত্তালিবও এই প্রস্তাব সমর্থন করলেন। পুনরায় মোহাম্মদ  হালিমার গৃহে ফিরে চললেন।

হযরত মুহাম্মদ সাঃ এর জীবন কাহিনী

হালিমার গৃহে অবস্থান কালে হযরত মুহাম্মদ এর জীবনে একটি অলৌকিক কান্ড ঘটেছিল। একদিন শিশু মোহাম্মদ তাঁর  দুধভাই ও অন্যান্যদের সাথে মাঠে মেষ চড়াচ্ছিলেন। এমন সময় একজন ফেরেশতা তাদের সম্মুখে আবির্ভূত হলেন। মোহাম্মদের হাত ধরে একটু আড়ালে নিয়ে গেলেন।

তারপর তাকে চিৎ করে শুইয়ে দিয়ে তার বুক চিরে কি যেন বাহির করলো। মুহাম্মদ সংজ্ঞাহীন অবস্থায় পড়ে রইলেন। দূর থেকে এই ব্যাপার লক্ষ্য করে বালকেরা ভয় পেয়ে দৌড়ে গিয়ে হালিমাকে বললেন- দেখ গিয়ে মোহাম্মদ নিহত হয়েছেন। সংবাদ পেয়ে হালিমা এবং তার স্বামী ছুটে এলেন। দেখলেন বাস্তবিকই মুহাম্মাদ অজ্ঞান অবস্থায় পড়ে আছে। তারা কিছুই বুঝতে পারলেন না।। মূলত এটি ছিল তাঁর সিনা সাফ করার একটি ঘটনা।

মহানবী সাঃ এর স্ত্রীদের নাম

হযরত মুহাম্মাদ (স.) তাঁর জীবদ্দশায় মোট ১৩টি বিবাহ করেছেন। বিবি খাদিজা ছাড়া আর বাকি ১২টি বিবাহ করেছেন ৫১-৬৩ বছর বয়সের মধ্যে, বিবি খাদিজার মৃত্যুর পরে। এক সুমহান আদর্শ ও প্রেরণা দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়ে তিনি এতগুলি বিবাহ করেছিলেন। নারীত্বের মর্যাদা দান, পরিজনদের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা অর্জন, অনুরোধ রক্ষা, আদর্শের পূর্ণতা সম্পাদন, কু-সংস্কারের উচ্ছেদ সাধন, আত্ম-ত্যাগের আদর্শ স্থাপন করার জন্যই মূলত তিনি একাধিক বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন।

হযরত মুহাম্মাদ (স.) জীবনে যে সকল নারীকে বিবাহ করেছেন তাদের নামের তালিকা এবং সংক্ষিপ্ত পরিচয় এবং হযরত কোন বয়সে কাকে বিবাহ করেছেন তা নিন্মে দেখানো হলো-

১। খাদিজা ( বিধবা) – হযরতের বয়স তখন ২৫ বছর

২। সাওদা- ( বিধবা) – হযরতের বয়স তখন ৫১ বছর

৩। আয়েশা- কুমারী- হযরতের বয়স তখন ৫২ বছর

৪। হাফসা ( বিধবা) – হযরতের বয়স তখন ৫৪ বছর

৫। জয়নাব বিনতে খোজাইমা ( বিধবা) – হযরতের বয়স তখন ৫৫ বছর

৬। উম্মে সালমা ( বিধবা) – হযরতের বয়স তখন ৫৫ বছর

৭। জয়নব (জায়েদের পরিত্যক্তা স্ত্রী)  – হযরতের বয়স তখন ৫৬ বছর

৮। জওয়ায়েরা ( বিধবা, বনি মুন্তালিক গোত্র) – হযরতের বয়স তখন ৫৬ বছর

৯। রায়হানা (ইহুদিনী, বিধবা) – হযরতের বয়স তখন ৫৭ বছর

১০। মেরী (খ্রিষ্টান, অপহৃতা,  বিধবা) – হযরতের বয়স তখন ৫৭ বছর

১১। সফিয়া ( কিনানার স্ত্রী, বিধবা, ইহুদিনী) – হযরতের বয়স তখন ৫৮ বছর

১২। উম্মে হাবিবা (আবু সুফিয়ানের কন্যা, বিধবা) – হযরতের বয়স তখন ৫৮ বছর

১৩। মায়মুনা (বৃদ্ধা, বিধবা) – হযরতের বয়স তখন ৫৯ বছর

 

Leave a Reply