মায়ের রক্তে ভাসছিল শিশুটি, খুনিরা বেঁধে দেয় মুখ: পুলিশ

এসি মেরামতের জন্য ঢুকে লুটপাট করছিল তারা; দেখে বাধা দিলে মাকে খুন করে, কোলে থাকা ১০ মাসের শিশুটি যখন মায়ের রক্তের মধ্যে কেঁদে উঠছিল, কান্নার সেই শব্দ আটকাতে তার মুখ বন্ধ করে দেয় স্কচটেপে।

ঢাকার সবুজবাগে গৃহবধূ তানিয়া আফরোজ হত্যাকাণ্ডে জড়িত তিনজনকে গ্রেপ্তারের পর তাদের কাছে এমন তথ্য পাওয়ার কথা জানিয়েছে পুলিশ। মঙ্গলবার পল্টন থানায় সংবাদ সম্মেলন করে আলোচিত এই হত্যাকাণ্ডের তদন্তে নিজেদের পাওয়া তথ্য সাংবাদিকদের জানান ঢাকা মহানগর পুলিশের মতিঝিল বিভাগের উপ কমিশনার (ডিসি) মো. আ. আহাদ। গত শনিবার এই হত্যাকাণ্ডের পর বাপ্পী নামে এসি মিস্ত্রি বা টেকনিশিয়ানকে সন্দেহ করা হচ্ছিল।

২৬ বছর বয়সী এই যুবকের পাশাপাশি সুমন হোসেন হৃদয় (২২) ও রুবেল (৪২) নামে আরও দুজন গ্রেপ্তার হয়েছেন। তানিয়ার স্বামী মাইনুল ইসলামের মামলায় সন্দেহভাজন প্রধান খুনি বাপ্পীকে আরও জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আদালতের মাধ্যমে হেফাজতে নিয়েছে পুলিশ। মঙ্গলবার তাকে আদালতে হাজির করে ১০ দিনের জন্য রিমান্ডে চান মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সবুজবাগ থানার পরিদর্শক (তদন্ত) শেখ আমিনুল বাশার। ঢাকার মহানগর হাকিম আফনান সুমী পাঁচ দিন রিমান্ডের আদেশ দেন। বাপ্পীসহ তিনজনের বাসা ঢাকার খিলগাঁও এলাকায় বলে জানিয়েছেন সবুজবাগ থানার ওসি ওসি মোরাদুল ইসলাম।

নিজের কণ্ঠস্বর নিয়ে এই ৭টি তথ্য আপনি জানেন কি?

পুলিশ জানায়, তারা এসি মেরামতের নামে একাধিক বাসায় ঢুকে সুযোগ মতো চুরি করেছে। গত শনিবার বিকালে তারা ঢুকেছিল সবুজবাগের বেগুনবাড়ি মাস্টার গলির চারতলা ভবনের দোতলায় মাইনুলের ফ্ল্যাটে। মেডিকেল কলেজের টেকনিশিয়ান মাইনুল মুগদা মেডিকেলে চাকরি করার সময় এই ফ্ল্যাটটি ভাড়া নেন। এখন তিনি ফরিদপুরে বদলি হলেও ঢাকার বাসাটি রেখেছেন। ওই বাসায় তার স্ত্রী তানিয়া তিন বছর বয়সী এবং ১০ মাস বয়সী দুই মেয়ে নিয়ে থাকতেন। হামলার সময় শুধু তারাই ছিলেন বাসায়। ঢাকা মহানগর পুলিশের মতিঝিল বিভাগের উপ কমিশনার (ডিসি) মো. আ. আহাদ। তিনজনকে জিজ্ঞাসাবাদে পুলিশ জানতে পেরেছে, সেদিন বিকালে বাপ্পী ও হৃদয় ওই বাসায় এসি সার্ভিসিং করতে যান। পরে রুবেলও যান। তানিয়া তখন ১০ মাসের ছেলেটিকে কোলে নিয়ে রান্নাঘরে রান্না করছিলেন। আর তিন বছরের শিশুটি স্বাভাবিক কৌতূহল নিয়ে তাদের শোবার ঘরে এসি মেরামতের কাজ দেখছিল।

উপকমিশনার আহাদ হত্যাকাণ্ডের বর্ণনা দিয়ে বলেন, “তানিয়া হঠাৎ বেডরুমে গিয়ে দেখেন, বাপ্পী ও রুবেল তার আলমারি খুলে সব বের করছে, কিছু খুঁজছে। দেখে তানিয়া চিৎকার করে ওঠেন। সঙ্গে সঙ্গে রুবেল তাকে বালিশ চাপা দিয়ে ফেলে দেয়। তারপরে বাপ্পী ব্যাগ থেকে চাপাতি বের করে তাকে কোপায়।” বাপ্পীর স্বীকারোক্তি উদ্ধৃত করে তিনি বলেন, “বাপ্পীর প্রথম কোপে তানিয়া বিছানায় পড়ে যায়, তার কোলের বাচ্চাটিও বিছানায় পড়ে। তানিয়ার মৃত্যু নিশ্চিত করতে মাথায় আরও একটি এবং পিঠে একটি কোপ দেওয়ার পর বিছানা রক্তে ভেসে যায়। ১০ মাস বয়সের শিশুটি কান্না করলে হৃদয় এই শিশুটির মুখেও স্কচটেপ লাগিয়ে দেয়।” তার আগে তিন বছরের মেয়েটির মুখ ও হাতও স্কচটেপে বেঁধেছিল খুনিরা। মেয়েটি বেশি কান্নাকাটি করলে তাকেও হত্যার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল খুনিরা। উপকমিশনার আহাদ বলেন, “বাপ্পী তিন বছরের মেয়েটিকেও কোপাতে চায়। তখন হৃদয় তাকে আটকায়।

এরপর হাত ও মুখ বাঁধা অবস্থায় শিশুটিকে বাথরুমে ঢুকিয়ে রাখে হৃদয়।” লুটপাট করে খুনিরা চলে যাওয়ার সময় বাথরুমের দরজা খুলে রেখে যায়। তখন বড় মেয়েটি বেরিয়ে আসে। এই বাথরুমে আটকে রাখা হয় তিন বছরের মেয়েটিকে। পুলিশ কর্মকর্তা আহাদ বলেন, “হাত-মুখ বাঁধা অবস্থায় পাশের বাসায় গিয়ে কনুই দিয়ে সে (বাসার) দরজায় নক করে। ওই বাসার মহিলা দরজা খুলে মুখ ও হাতের স্কচটেপ খুলে দিয়ে জিজ্ঞেস করেন, ‘কী হয়েছে?, তখন শিশুটি বলে, ‘মারছে মারছে, মাকে মারছে’। ওই নারী জিজ্ঞেস করেন, ‘কে মারছে?’ শিশুটি বলে, ‘লোক লোক’।” পাশের ফ্ল্যাটের ওই নারী তখন ছুটে এসে দেখেন চুলা জ্বলছে, রান্নায় থাকা তরকারি পুড়ে যাচ্ছে। তিনি আগে চুলা নেভান। পরে খুনের ঘটনা দেখে পুলিশকে খবর পাঠানোর উদ্যোগ নেন। উপকমিশনার আহাদ বলেন, “পাশের বাসার মহিলা এসে ছোট শিশুটিকে মুখে স্কচটেপ এবং মায়ের রক্তের মধ্যে পড়ে থাকতে দেখেন। এসময় শিশুটির বেশ শ্বাসকষ্ট হচ্ছিল। পরে তাকে তাড়াতাড়ি উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়।

আর কিছুক্ষণ পর হলেই শিশুটি মারা যেতে পারত।” ছোট শিশুটি সোমবার হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়েছে। বড় মেয়েটি ঘটনার পর থেকে ভীষণ চুপচাপ হয়ে গেছে বলে জানিয়েছেন তার বাবা মাইনুল, যা নিয়ে উদ্বেগে রয়েছেন তিনি। মায়ের হত্যাকাণ্ড দেখে চুপচাপ শিশুটি, উদ্বিগ্ন বাবা মায়ের হত্যাকাণ্ড দেখে চুপচাপ শিশুটি, উদ্বিগ্ন বাবা খুনের পরও রান্নাঘরের চুলা জ্বলছিল, প্রতিবেশী নারী এসে তা নেভায়। যেভাবে ঢুকেছিল খুনিরা দেড় বছর আগে ওই বাসায় শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র (এসি) লাগিয়ে এসেছিল বাপ্পী; সেই সূত্রে পরিবারটি তার চেনা। এর মধ্যে তিনি জানতে পারেন যে এসিটি নষ্ট হয়েছে। উপকমিশনার আহাদ বলেন, “ঘটনার দিন সহকর্মী হৃদয়কে নিয়ে বাপ্পী ওই দম্পতির বাসায় গিয়ে নিচতলায় কলাপসিবল গেটে তালা দেখে নাড়া দেয়। তানিয়া আসার পর বাপ্পী জানতে চায়, এসি ঠিক করা লাগবে কি না? তানিয়া তখন তার স্বামীর সাথে ফোনে কথা বলিয়ে দেন। তখন মইনুল বলেন যে তিনি ঢাকায় নাই, সার্ভিসিং পরে করাবেন।

কথা বলার জড়তা কাটাতে

“পরে ফোনটি নিয়ে তানিয়া তার স্বামীর সঙ্গে কথা বলতে বলতে দোতলায় চলে যান এবং একটু পরেই স্বামীর সম্মতি নিয়ে ফিরে এসে দরজা খুলে দিলে তারা দুইজন (বাপ্পী-হৃদয়) ঢুকে।” তিনি বলেন, এসি ঠিক করার মধ্যে প্রায় আধা ঘণ্টা পর বাপ্পী তার আনার কথা বলে নিচে নামেন এবং কিছুক্ষণ পর রুবেলকে নিয়ে ঢুকে ঢোকেন। ততক্ষণে বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা নেমেছে। রুবেলকে দেখে তার পরিচয় জানতে চান তানিয়া। বা্প্পী তখন বলেন যে রুবেলও তার মতো এসি টেকনিশিয়ান। গৃহবধূ হত্যা: এসির টেকনিশিয়ান শনাক্ত, খুঁজছে পুলিশ এই ফ্ল্যাটেই খুন হন তানিয়া আফরোজ। ওঁৎ পেতে ছিল উপকমিশনার আহাদ বলেন, এই বাসায় চুরির জন্য আগে থেকে খোঁজ-খবর নিয়ে রেখেছিলেন বাপ্পী। “বাপ্পী বেশ কদিন ধরে এই বাসাটি ওয়াচ করছিল। খোঁজ নিয়ে জেনেছে যে মইনুল ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে বদলি হয়েছে। মাঝে মাঝে ঢাকায় আসে। কবে কবে আসে, এটাও খোঁজ নিয়েছে।

ঘটনার দিন মইনুল বাসায় নেই এবং এটা নিশ্চিত হয়েই সে পরিকল্পনা করেই ওই বাসায় যায়।” ওই বাসার আলমারিতে থাকা স্বর্ণালংকার, তানিয়ার কানে থাকা দুল, তিন বছরের শিশু কন্যার গলায় থাকা স্বর্ণের চেইন, তানিয়ার মোবাইল ফোন লুট হয়েছিল। বাপ্পীদের গ্রেপ্তারের পর দুটি স্বর্ণের চেইন, এক জোড়া কানের দুল উদ্ধার করা হয় বলে জানান উপকমিশনার আহাদ। তিনি বলেন, এসি ঠিক করার নামে ঢুকে একাধিক বাসায় চুরি করার কথা বাপ্পী স্বীকার করেছেন। পুলিশ কর্মকর্তা আহাদ জানান, বাপ্পীকে সোমবার ঝালকাঠির নলছিটির গ্রামের বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার করা হয়।

তাকে জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে মঙ্গলবার ঢাকার রামপুরা এলাকা থেকে হৃদয় ও রুবেলকে গ্রেপ্তার করা হয়। সংবাদ সম্মেলনে অতিরিক্ত উপ কমিশনার (সবুজবাগ) শাহ আলম মো. আখতারুল ইসলাম, সহকারী কমিশনার (সবুজবাগ) মনতোষ বিশ্বাস, সবুজবাগ থানার ওসি মোরাদুল ইসলাম উপস্থিত ছিলেন। ওসি মোরাদুল বলেন, “বাপ্পী ও রুবেলের বিরুদ্ধে কোনো মামলা না থাকলেও তারা এসি ঠিক করার নামে একাধিক বাসায় গিয়ে সুযোগমতো চুরি করে করেছে।” হৃদয়ের বিরুদ্ধে চোখে মলম দিয়ে ছিনতাইয়ের ঘটনার একাধিক মামলার তথ্য পেয়েছেন বলে জানান তিনি।

 

Leave a Reply